ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের ইরান বিরোধ এবং গত বছরের গোপন সিদ্ধান্ত

গত বছরের শরতে, তখনো ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হননি, এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগও শুরু হয়নি। এই সময়েই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গোপনে ইরানের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা হাতে নেন। ইসরায়েলের বর্তমান ও সাবেক একাধিক সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভঙ্গ করে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহকে দুর্বল করার মাধ্যমে তাদের সামরিক সক্ষমতা কমাতে শুরু করে।
নেতানিয়াহুর নির্দেশে গোয়েন্দারা গোপন বৈঠকে ইরানের প্রধান পরমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের তালিকা প্রস্তুত করে, যাদের ভবিষ্যতে লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে। একই সময়, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী নিয়মিত লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের আকাশপথে আক্রমণ চালিয়ে আকাশপথ পরিষ্কার করার কাজ চালায়, যাতে ভবিষ্যতে ইরানবিরোধী হামলায় সুবিধা হয়।
ওয়াশিংটনের সমর্থন জরুরি: ইসরায়েলি কূটনীতি ও গোয়েন্দা সহযোগিতা
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে একক সামরিক অভিযান সফল হবে না। তাই গত বছরের শেষের দিকে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক সূত্রের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। আলোচনায় উঠে আসে ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির তাত্ত্বিক গবেষণা শুরু করার সম্ভাবনা। যদিও মার্কিন গোয়েন্দারা তখন বলছিলেন, শীর্ষ নেতৃত্ব এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কিন্তু ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ আলোচনা অন্যরকম ছিল। মার্চ ২০২৫-এ তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যুক্তরাষ্ট্র অংশ নাকরে হলেও জুনের মধ্যে হামলা চালানো হবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেতানিয়াহু ৭ এপ্রিল ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এটি ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ, কারণ ইরান তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত পুনর্গঠন করতে শুরু করবে।
ট্রাম্পের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ
১৩ জুন ভোরে নেতানিয়াহু ইরানে আকস্মিক হামলা চালান, যা ছিল গোপনে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফল। যদিও ট্রাম্প তখনো ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তবে পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। এই সিদ্ধান্ত আমেরিকান প্রশাসনের ভেতরে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের মতে, ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু ট্রাম্পের বিশ্বাস ছিল, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে খুব কাছাকাছি।
নেতানিয়াহুর দীর্ঘমেয়াদি ইরান বিরোধ এবং সামরিক পরিকল্পনা
বেশ কয়েক বছর ধরে নেতানিয়াহু ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় বলা করতেন এবং যুদ্ধবিরোধী কৌশলেই তাকে থামাতে চান। যদিও সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে এখনো কয়েক মাস থেকে এক বছর দূরে রয়েছে। তবে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বের কাছে উদ্বেগ অনেক বেশি।
একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত ছিল সুযোগ আর প্রয়োজনের সমন্বয়। ইসরায়েলি বাহিনী কখনো এত প্রস্তুত ছিল না, আর ইরান ও তার মিত্র শক্তিরাও কখনো এত দুর্বল ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণেই নয়, প্রয়োজনের তাগিদে তারা হামলা চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষত, পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ইরানের অগ্রগতির পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় হামলার বৈধতা নিয়ে বিতর্ক চলছে। মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে এই বিষয়ে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, যেখানে ট্রাম্প ও তার গোয়েন্দারা ভিন্ন মত পোষণ করছেন।
ইসরায়েলের সরকারপন্থী টিভি চ্যানেল-১৪-এর এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দুই সপ্তাহ আগে, তবে এই ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ তিনি কয়েক মাস আগেই নিয়েছিলেন।
সার্বিক বিশ্লেষণ: কেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই মুহূর্তটি গুরুত্বপূর্ণ?
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ইসরায়েলকে একটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়া অবরুদ্ধ না করলে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই নেতানিয়াহু তার ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ নিয়েছিলেন আগে থেকে, যেটি বাস্তবায়িত হলো যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটি ছিল একটি কৌশলগত সংকট মোকাবিলার সুযোগ। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে প্রভাব বাড়ানোর পাশাপাশি, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ঠেকানো ছিল তাদের লক্ষ্য। যদিও গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা ভিন্নমত পোষণ করলেও, ট্রাম্প প্রশাসন এই অভিযানে সরাসরি অংশ নেয়।
ভবিষ্যতের জন্য ইঙ্গিত
বর্তমানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক পদক্ষেপ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে প্রতিরোধ করতে পারে। তবে ইরান ও তার মিত্রশক্তি লেবাননের হিজবুল্লাহসহ সিরিয়া, ইরাকের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে পারে, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্য অস্থিতিশীল হতে পারে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সমাজের মাঝে কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে, যা ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আলোচনা কঠিন করবে।
সিগনালবিডির পাঠকদের জন্য বিশেষ বিশ্লেষণ
- ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: বেসামরিক ও সামরিক ব্যবহারের মধ্যে বিভাজন ও বিশ্বসন্ধানের গুরুত্ব
- ইসরায়েলের নিরাপত্তা চাহিদা: পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলা
- যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি: মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা
- ভবিষ্যতের ঝুঁকি: আঞ্চলিক যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির আশঙ্কা
আপনি যদি মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনার বিশদ তথ্য জানতে চান বা ইরান-ইসরায়েল সংকটের প্রভাব সম্পর্কে আরও জানতে চান, আমাদের সিগনালবিডি.কম-এ নিয়মিত অনুসরণ করুন।