মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটির আর কোনো স্থান থাকবে না: হুঁশিয়ারি খামেনেয়ির উপদেষ্টার

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়াতি সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেছেন, যেখানে তিনি সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে যায়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলোর আর কোনো স্থান থাকবে না। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাকারী যেকোনো দেশও ইরানের বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
বেলায়াতির এ মন্তব্য ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে রোববার (২২ জুন) জানানো হয়, তিনি এক সাক্ষাৎকারে এই কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা
আলী আকবর বেলায়াতি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যেসব হামলা চালিয়েছে, তা ইরানের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন। আমরা তাদের জানিয়ে দিতে চাই, যদি তারা আবার এমন হামলা চালায়, তবে এ অঞ্চলে তাদের কোনো সামরিক ঘাঁটি নিরাপদ থাকবে না। ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়া অন্য কোনো দেশও যদি এই হামলাকে সমর্থন জানায় বা সাহায্য করে, তাহলে তাদের ভূখণ্ডে থাকা ঘাঁটিও আমাদের বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।”
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) হুঁশিয়ারি
ইরানি অভিজাত বাহিনী আইআরজিসিও এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা এক বিবৃতিতে জানায়, মার্কিন হামলার উৎসস্থল ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছে তেহরান। তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে, “যেখান থেকে আগ্রাসন এসেছে, সেই স্থানই হবে আমাদের জবাবের মূল টার্গেট।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইআরজিসির এই বক্তব্য কেবল রাজনৈতিক নয়; বরং এটি ভবিষ্যৎ সামরিক পদক্ষেপের সরাসরি পূর্বাভাস। ইরান এর মাধ্যমে মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে হুমকির আওতায় এনে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোর অবস্থান
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ইরাক: একাধিক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম আল-আসাদ এয়ারবেস, যা অতীতে ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।
- সৌদি আরব ও কুয়েত: মার্কিন সেনাদের ঘাঁটি রয়েছে এবং এখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন সামরিক কার্যক্রম চালানো হয়।
- কাতার: আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি বিশ্বের অন্যতম বড় মার্কিন সামরিক স্থাপনা।
- সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও জর্ডান: এসব দেশেও মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, যা কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নজরদারি ও সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়ে থাকে। ইরান বহুদিন ধরেই এ ঘাঁটিগুলোকে নিজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে আসছে।
অতীতের দৃষ্টান্ত: ২০২০ সালের হামলা
২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করে। এর জবাবে ইরান ইরাকের আল-আসাদ বিমানঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সে হামলায় মার্কিন সেনারা মারাত্মকভাবে আহত হলেও কেউ নিহত হয়নি বলে দাবি করেছিল পেন্টাগন।
সেই ঘটনার পর থেকেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছে যায়। দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা অব্যাহত আছে এবং উভয় পক্ষই প্রায়শই একে অপরকে হুমকি দিয়ে থাকে।
বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. হামিদ রেজা জানান, “আলী আকবর বেলায়াতির বক্তব্য ইরানের রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিফলন। এটি কূটনৈতিক বার্তা হলেও সামরিক হুমকি হিসেবেই গণ্য হবে। তেহরান চাইছে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য কমাতে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক উইলিয়াম জ্যাকবস বলেন, “ইরানের এসব হুমকি কেবল কথার খেলাই নয়। অতীতে তারা যেভাবে সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, তা আবারও ঘটতে পারে।”
অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল
মধ্যপ্রাচ্য এমনিতেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অস্থিতিশীল অঞ্চল। ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় সংঘর্ষের কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা এই অস্থিরতাকে আরও গভীরতর করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো বড় ধরনের সামরিক সংঘাত শুরু হলে তা কেবল ইরান বা যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপসংহার
আলী আকবর বেলায়াতির কড়া হুঁশিয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে ইরান পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে যে, তারা আর পেছনে হটবে না। একইসঙ্গে, তেহরান আশেপাশের মিত্র দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করে, তবে তাকেও ফল ভোগ করতে হবে।
এখন বিশ্বের চোখ দুই পক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোলা থাকলেও সামরিক সংঘাতের ছায়া অনেকটা ঘন হয়ে উঠছে।