বানিজ্য

বিশ্ববাজারে আজও বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে তীব্র সামরিক উত্তেজনার কারণে তেলের দাম দিন দিন বাড়ছে। গত শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ইরানের পরমাণু স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিতে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা বিশ্বজুড়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ব্রেন্ট ক্রুড এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) তেলের দাম কেমন বাড়ল?

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ১৫ জুন ২০২৫ সোমবার সকালে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি ব্যারেল ৭৫.৩৫ ডলার, যা আগের দিনের তুলনায় ১.১২ ডলার বা প্রায় ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের WTI তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ৭৪.৮ ডলার, যা ১.১০ ডলার বা প্রায় ১.৫ শতাংশের সমান। গত শনিবার তেলের দাম তিন শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুক্রবারের বিমান হামলার পর একদিনেই তেলের দাম ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়, যা ২০২২ সালের মার্চ মাসের পর সবচেয়ে বড় উর্ধ্বগতি। এই বড় ধাক্কায় বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য গভীর সংকটে পড়ে।

ইসরায়েল-ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষাপট

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাগুলো চার দিন পার হয়ে গেলেও পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আলামত মেলেনি। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌ পথ ‘হরমুজ প্রণালী’ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে।

হরমুজ প্রণালী হলো বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবহনের প্রধান রুট। ইরানের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরান প্রয়োজনবোধে এই প্রণালী বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। তবে বিশ্ববাজারে এটি দামের আরো বড় স্ফীতি আনতে পারে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রভাব: বিশ্লেষকদের উদ্বেগ

গোল্ডম্যান স্যাকসের এক বিশ্লেষণ মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারেরও বেশি হয়ে যেতে পারে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সামরিক ও কূটনৈতিক কারণে ইরানের পক্ষে পুরোপুরি এই প্রণালী বন্ধ করা কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনের জলসীমায় অবস্থান করছে, যা ইরানের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।

আরবিসি ক্যাপিটালের হেলিমা ক্রফট বলেন, যদিও প্রণালী বন্ধ করা কঠিন, তবে ইরান ট্যাংকার হামলা বা প্রণালিতে মাইন স্থাপন করতে পারে, যা সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া প্রণালী বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলে সমস্যা হবে, আমদানি-রপ্তানি বিলম্বিত হবে, এবং খরচ বেড়ে যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি ভয়ঙ্কর সংকেত। পণ্য সময়মতো সরবরাহ না হলে আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ওপর প্রভাব

মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনা এমন সময় ছড়িয়ে পড়েছে, যখন বিশ্ববাজার বিভিন্ন সংকট ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি এবং বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার বিপর্যস্ত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বসানোর হুমকি বেড়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাচ্ছে।

ফলশ্রুতিতে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসায়িক খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আর বিশ্ব অর্থনীতির গতি মন্থর হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সাথে মিলিয়ে বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা তীব্র করছে।

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব

বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের শিল্প ও পরিবহন খাতের সরাসরি প্রভাব পড়বে, যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়তে পারে, পণ্যের খরচ বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের দাম থেকে দেশের অর্থনীতি রক্ষা করা যায়। এছাড়া জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানো, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি বিকল্প শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য অবস্থা ও বিশ্ব বাজারের প্রভাব

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং সামরিক উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যত দিন বাড়বে, তেলের দাম তত বেশি বাড়বে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে, যা গ্লোবাল ইনফ্লেশন এবং অর্থনৈতিক মন্দাকে তীব্র করবে।

ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রধান কারণ। হরমুজ প্রণালীর সম্ভাব্য অবরোধ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বিশ্ব ও বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

সুতরাং, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বিকল্প শক্তি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্ব ও দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button