বাংলাদেশ

 হানিট্র্যাপের ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক তুহিনকে হত্যা: জিএমপি কমিশনার

 গাজীপুর মহানগরে আলোচিত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডের পেছনে ‘হানিট্র্যাপ’ ফাঁদই প্রধান কারণ বলে দাবি করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান। শনিবার (৯ আগস্ট) বিকেলে এক জরুরি সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, তুহিন এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছিলেন, যা মুছে ফেলতে অস্বীকৃতি জানানোর পরই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

ঘটনার বিস্তারিত

জিএমপি কমিশনারের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনার দিন চান্দনা চৌরাস্তার এলাকায় পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী নামের এক নারীকে ব্যবহার করে হানিট্র্যাপের ফাঁদ পাতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। বাদশা নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলছিলেন। এসময় পারুল তার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। কথোপকথনের একপর্যায়ে বাদশা ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাপীকে ঘুষি মারেন।

ঘটনাটি আগে থেকেই পরিকল্পনা করা থাকায় ওৎ পেতে থাকা গোলাপীর সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাদশাকে আঘাত করে। বাদশা দৌঁড় দিলে সন্ত্রাসীরা তাকে ধাওয়া করে। এই পুরো ঘটনাটি কাছাকাছি অবস্থান থেকে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন।

হত্যার নেপথ্যের কারণ

পুলিশ জানায়, ঘটনার পর চক্রের সদস্যরা তুহিনকে ভিডিও মুছে ফেলতে হুমকি দেয়। কিন্তু তুহিন সাংবাদিকতার নৈতিকতা বজায় রেখে ভিডিওটি মুছে ফেলতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।

জানা যায়, তুহিন প্রথমে পাশের একটি মুদি দোকানে আশ্রয় নেন। কিন্তু হামলাকারীরা সেখানেও ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার উপর হামলা চালায়। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

পুলিশি ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি

সংবাদ সম্মেলনে জিএমপি কমিশনার স্বীকার করেন যে, এই হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, “এই ঘটনার দায় আমরা এড়াতে পারি না। জনবল স্বল্পতা ও কিছু ত্রুটি ছিল। সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের ছিল, কিন্তু আমরা তা যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি।”

তিনি আরও জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। পাশাপাশি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার আশ্বাস দেন।

গ্রেপ্তার ও অগ্রগতি

তুহিন হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে জিএমপি এবং ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন—জামালপুরের মেলানদহ থানার মাহমুদপুর গ্রামের ফয়সাল ওরফে কেটু মিজান (৩৪) ও তার স্ত্রী গোলাপী বেগম (২৮), পাবনার ফরিদপুরের স্বাধীন (২৮), খুলনার আল-আমিন (২১), শেরপুরের সুমন ওরফে সাব্বির (২৬), কুমিল্লার মো. শাহ জালাল (৩২) এবং মো. শহিদুল।

হানিট্র্যাপ পদ্ধতি ও ঝুঁকি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ‘হানিট্র্যাপ’ হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে নারীকে ব্যবহার করে কাউকে ফাঁদে ফেলে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইল বা অন্যান্য অপরাধ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরণের অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে, যা সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের অপরাধ ঠেকাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুলিশের গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরি।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

তুহিন হত্যার ঘটনায় গাজীপুরে সাংবাদিক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয়রা জানান, তিনি সবসময় সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। তার হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন তারা।

গাজীপুর প্রেসক্লাবের নেতারা বলেছেন, “একজন সাংবাদিককে এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।”

শেষ কথা 

তুহিন হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি দেশের সাংবাদিকতা ও জননিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য বড় একটি সতর্কবার্তা। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা ও শাস্তি নিশ্চিত করাই এখন প্রধান দাবি। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এমন ঘটনা রোধে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান কবে আসবে?

এম আর এম – ০৭৬০, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button