বিশ্ব

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অবস্থান জানি, তবে এখন হত্যা করব না: ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের একবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে তিনি এক স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যেখানে তিনি জানিয়েছেন—ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অবস্থান মার্কিন প্রশাসনের জানা রয়েছে। তবে এখনই তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একাধিক পোস্টে এই বক্তব্য তুলে ধরেন ট্রাম্প, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

খামেনি ‘সহজ লক্ষ্য’, তবে এখনই নয়

ট্রাম্প বলেন, “আমরা জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় আছেন। তিনি একটি সহজ টার্গেট, তবে তিনি আপাতত নিরাপদে আছেন। আমরা তাকে এখনই হত্যা করব না।”

এই বক্তব্য অনেকের কাছেই আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সময়ের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ আরও চড়াবে। পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়মনীতি ও নেতৃত্বের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

ট্রাম্প আরও বলেন, “আমরা চাই না বেসামরিক নাগরিক বা সেনাদের ওপর কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হোক। তবে আমাদের ধৈর্য সীমিত। বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

ইরানের আকাশসীমা ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে’: দাবি ট্রাম্পের

এমন উত্তপ্ত বিবৃতি দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইরানের আকাশসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা এখন আকাশপথে যে কোনো চলাচল পর্যবেক্ষণ করতে পারছি। এটি আমাদের কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করেছে।”

তেহরানে ‘স্থানান্তরের’ আহ্বান

এর আগে দেওয়া আরেকটি পোস্টে ট্রাম্প সরাসরি ইরানের রাজধানী তেহরানের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান, তারা যেন শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যান। এমন বক্তব্য অনেকেই যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবেই দেখছেন।

ইসরায়েলের তীব্র হামলা, পাল্টা জবাব ইরানের

মঙ্গলবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা ইরানের ইসফাহান শহরে একযোগে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। শহরটির বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেছে বলে আল-জাজিরার খবরে উল্লেখ করা হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলো অকার্যকর করে দেওয়া।

এই প্রেক্ষিতে ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীও সরব হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানায়, ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ৮টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত ইসরায়েলের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের দিকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়।

ক্ষেপণাস্ত্র হামলার গতি কিছুটা হ্রাস

যুদ্ধের শুরুতে ইরান একসঙ্গে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও, গত দুই দিনে সেই সংখ্যা কমে এসেছে। এটি হয়তো কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, নয়তো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ বা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বাছাইয়ে কিছুটা রক্ষণশীলতা দেখা যাচ্ছে।

ট্রাম্পের বক্তব্যের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিশ্বের নানা দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। একাধিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এমন প্রকাশ্য হুমকি কেবল উত্তেজনা বাড়াবে না, বরং এটি যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর আলোচনায়ও স্থান করে নিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের সাবেক কূটনীতিক অ্যান্ড্রু হারিস বলেন, “একজন রাষ্ট্রনেতার মুখে যদি আরেক দেশের প্রধান ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার ঘোষণা আসে, তা সরাসরি জাতিসংঘের নীতিমালার পরিপন্থী। এমন বক্তব্য কূটনৈতিক পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে।”

রাশিয়া ও চীনের উদ্বেগ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ঘিরে রাশিয়া ইতোমধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। মস্কো জানিয়েছে, তারা সংঘাত নিরসনের জন্য উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। চীনও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এই সংঘাত অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠলে তা সারা মধ্যপ্রাচ্যকেই বিপর্যস্ত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি

মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এই ঘটনাকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, যদি কোনো রাষ্ট্রনেতা আরেকজন রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় নেতাকে হত্যা করার প্রকাশ্য পরিকল্পনা করেন, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের সামিল।

যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্তমান চিত্র

ইসরায়েল ও ইরানের এই চলমান সংঘাতে পঞ্চম দিনে পা দিয়েছে। এরই মধ্যে ইরানে ইসরায়েলের হামলায় ৪৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানি মানবাধিকার সংস্থা। এর বিপরীতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে ইসরায়েলেও বেশ কিছু বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, যদিও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা বা ট্রাম্পের মতো নেতার হুঁশিয়ারি আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় ধরনের সংঘর্ষের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

উপসংহার

বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতির প্রতিটি উত্তাল তরঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আছে, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিত্ব সেই প্রভাবকে একাধিকবার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ দিয়েছেন। ইরানকে নিয়ে তাঁর সর্বশেষ মন্তব্য একটি স্পষ্ট বার্তা—যুক্তরাষ্ট্র শুধু যুদ্ধের বাইরে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে না, বরং প্রয়োজনে সরাসরি অংশগ্রহণের প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো—এই সংঘাত যাতে আরও বিস্তৃত না হয়, তা নিশ্চিত করা। আর সে জন্য কূটনৈতিক চাপ, মানবিক উদ্বেগ ও শান্তিপূর্ণ উদ্যোগই হতে পারে একমাত্র পথ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button