ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে ইসরায়েলের হামলা

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ক্রমাগত উত্তেজনার মাঝে এবার সরাসরি গণমাধ্যম অবকাঠামোতে হামলার ঘটনা ঘটল। ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান ব্রডকাস্টিং (আইআরআইবি)-এর প্রধান কার্যালয়ে ভয়াবহ মিসাইল হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সোমবার রাতের এ হামলায় তেহরানজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
লাইভ সম্প্রচারে বিস্ফোরণ
ঘটনার সময় টেলিভিশনের এক নারী উপস্থাপিকা সরাসরি সম্প্রচারে ছিলেন। সম্প্রচারের মাঝে হঠাৎ করেই একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। কেঁপে ওঠে পুরো স্টুডিও। আতঙ্কিত উপস্থাপিকা দ্রুত স্টুডিও ত্যাগ করেন এবং সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জানান, হামলার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।
ইসরায়েলের পূর্ব হুমকি
হামলার কিছুক্ষণ আগেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ মন্তব্য করেন, “ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিও ‘অদৃশ্য হয়ে যাবে’।“ এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমন হামলা কৌশলগত বার্তা হিসেবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
আইআরআইবি: ইরানের গণমাধ্যমের হৃদপিণ্ড
আইআরআইবি শুধু একটি টিভি স্টেশন নয়; এটি ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রাণকেন্দ্র। এখানে রয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও সার্ভিস এবং নিউজ এজেন্সির প্রধান দপ্তর। এটি ইরানের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম সংস্থা। সংস্থাটি সরাসরি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অধীনস্থ।
আইআরআইবি-তে হামলার ঘটনা ইরানের জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার তাদের বার্তা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়। সেই কেন্দ্রবিন্দুতে হামলা সরকারের মর্যাদাকেই চ্যালেঞ্জ করেছে।
হামলার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের বিমান বাহিনী অত্যাধুনিক মিসাইল ব্যবহার করে আইআরআইবি ভবন লক্ষ্য করে আঘাত হানে। অন্তত দুটি মিসাইল ভবনের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানে। এতে করে স্টুডিও, সার্ভার রুম, এবং সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণকক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যদিও হামলায় প্রাণহানির নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি, তবে আহতদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কয়েকজন কর্মী গুরুতর আহত অবস্থায় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছেন বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “গণমাধ্যম অবকাঠামোয় হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
রাশিয়া, চীন, এবং তুরস্ক এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলকে ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সকল পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানান।
যুদ্ধাপরাধের সম্ভাবনা?
গণমাধ্যম অবকাঠামো, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র, লক্ষ্য করে হামলা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইআরআইবি’র মতো অবকাঠামোতে হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গৃহীত হতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উভয়ই ঘটনাটির স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে। তারা বলেছে, সাংবাদিকতা এবং তথ্যপ্রবাহের ওপর সরাসরি আক্রমণ একটি অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয় আচরণ।
ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনার পটভূমি
গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা চরমে পৌঁছেছে। সিরিয়াতে ইরানি অবস্থানে ইসরায়েলের বিমান হামলা, লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ এবং সম্প্রতি ইসরায়েলে ড্রোন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও তীব্র হয়েছে।
ইরান এর আগে ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছিল। ফলে এই টেলিভিশন ভবনের ওপর হামলাকে যুদ্ধের এক নতুন মাত্রা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানি জনগণের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ইরানি জনগণ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানান। অনেকেই সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অনেকে আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন।
বিশেষ করে তরুণ সমাজ এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সরকারকে আরও কৌশলগত ও আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
উপসংহার
আইআরআইবি কার্যালয়ে ইসরায়েলের হামলা শুধু একটি ভবন ধ্বংসের ঘটনা নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের তথ্য, পরিচয় ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত। এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘর্ষের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক মহলের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেষ্টার মধ্যেই এমন একটি পদক্ষেপ ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
এখন দেখার বিষয়—ইরান কীভাবে এর জবাব দেয় এবং আন্তর্জাতিক সমাজ কীভাবে এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানায়।