বিশ্ব

ইসরায়েলি হামলায় ইরানে ব্যাপক প্রাণহানি: নিহত ৩০ সেনা ও রেড ক্রিসেন্ট কর্মী

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর চালানো একটি ভয়াবহ হামলায় ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে কমপক্ষে ৩০ জন সেনা সদস্য এবং একজন রেড ক্রিসেন্ট কর্মী নিহত হয়েছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। এই হামলায় আরও ৫৫ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রদেশের গভর্নর বেহরাম সারমাস্ত জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনী একযোগে ১৯টি স্থানে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই পূর্ব আজারবাইজানের রাজধানী তাবরিজে অবস্থিত। তিনি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “তাবরিজ শহর ছিল ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য। এই হামলার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার ও চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।”

ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং উপযুক্ত প্রতিউত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সহিংসতা বন্ধের জন্য জরুরি আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

হামলার বিস্তারিত

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী অত্যাধুনিক ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এই হামলা চালিয়েছে। হামলার লক্ষ্য ছিল তাবরিজের সামরিক স্থাপনা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। স্থানীয় সূত্র জানায়, হামলায় বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি এবং রেড ক্রিসেন্টের একটি ত্রাণ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গভর্নর সারমাস্ত জানান, হামলার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, তাবরিজের বেশ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। উদ্ধারকারী দল এবং জরুরি সেবা সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত পৌঁছে কাজ শুরু করেছে। তবে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেকে আটকা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া

ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, “এই হামলা ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির আরেকটি প্রমাণ। আমরা এই আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেব।”

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এই ঘটনার তদন্ত এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েলের এই হামলা শুধু ইরানের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত নয়, এটি সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই হামলার পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সকল পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে আরও সংঘাতের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা সকল পক্ষকে উত্তেজনা হ্রাস করতে এবং শান্তির পথে ফিরে আসতে বলছি।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, “এই ধরনের হামলা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে আরও নাজুক করে তুলছে। আমরা সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে।”

এদিকে, রাশিয়া এবং চীনও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং সকল পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানাই।”

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার প্রভাব

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতাকে আরও তীব্র করবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যে ইয়েমেন, সিরিয়া, এবং লেবাননের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। এই হামলা অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

ইরানের সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ ইতোমধ্যে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। হিজবুল্লাহর একজন মুখপাত্র বলেন, “ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। আমরা আমাদের মিত্র ইরানের পাশে আছি।”

এদিকে, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাবরিজের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা শান্তিতে বাঁচতে চাই। এই ধরনের হামলা আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সহিংসতা বন্ধ করা।”

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলমান। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রভাব, এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি যুদ্ধ এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করেছে। ইসরায়েল বারবার ইরানের সামরিক স্থাপনা এবং এর সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা চালিয়েছে। এই হামলা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে, এবারের হামলার তীব্রতা এবং প্রাণহানির পরিমাণ পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর তুলনায় বেশি। ফলে, এটি ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান এই হামলার জবাবে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে অথবা তার সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে পারে। তবে, এটি অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক পথে সমাধানের চেষ্টা করছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

উপসংহার

ইসরায়েলের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর শান্তি ব্যবস্থাকে আরও বিপন্ন করেছে। ইরানের প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এই সংকটের পরবর্তী দিক নির্ধারণ করবে। সকল পক্ষের উচিত সংযমী হওয়া এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button