বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের সব দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা

বিশ্বজুড়ে উত্তেজনার পারদ চরমে। শুক্রবার ভোরে ইরানের অন্তত আটটি শহরে ব্যাপক বিমান হামলা চালানোর পর এবার নিজেদের সব দূতাবাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এই পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে এক নতুন সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছে।
দূতাবাস বন্ধ ও নিরাপত্তা সতর্কতা
১৩ জুন, শুক্রবার, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাসগুলোর ওয়েবসাইটে একযোগে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়, তারা সকল কনস্যুলার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করছে এবং দূতাবাসগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে।
একইসাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত ইসরায়েলি নাগরিকদের জনবহুল এলাকা এড়িয়ে চলা, ইসরায়েলি বা ইহুদি প্রতীক ও পোশাক ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়। এই সতর্কতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তারা যে কোনও ধরনের প্রতিশোধমূলক হামলার শঙ্কা করছে।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “বর্তমান বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায়, আমাদের কূটনৈতিক স্থাপনাগুলো এবং সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের বিপদে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে ইসরায়েলি নাগরিকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
তবে কবে নাগাদ এই দূতাবাসগুলো আবার খুলবে, তা এখনো স্পষ্টভাবে জানায়নি ইসরায়েল।
ইরানে নজিরবিহীন বিমান হামলা
দূতাবাস বন্ধ ঘোষণার পেছনে যে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তা হলো ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরানবিরোধী সামরিক অভিযান। শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী ইরানের রাজধানী তেহরানসহ অন্তত আটটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের পরমাণু ও সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে অন্তত ১০০টি স্থাপনায় আঘাত হানা হয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদনে জানানো হয়, হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র, রেভোল্যুশনারি গার্ডের ঘাঁটি এবং সামরিক কমান্ড সেন্টার।
নিহতদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় সামরিক ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা
এই হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভোল্যুশনারি গার্ড কোরের প্রধান হোসেইন সালামি, পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরেয়দুন আব্বাসি এবং মোহাম্মদ তেহরানচি নিহত হয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন ইরানের সাম্প্রতিক পরমাণু কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী বলে মনে করা হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি শুধুমাত্র একটি প্রতিক্রিয়া নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিচালিত হামলা। ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত করছে যে তারা ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি দ্রুত অশান্তির দিকে যাচ্ছে। আমরা সকল পক্ষকে সংযত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি এবং শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছি।”
রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকেও উভয় দেশকে সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীন এই হামলাকে ‘সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের নজির’ বলে অভিহিত করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা শুধু ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে নয়, বরং পুরো অঞ্চলকে অস্থিরতার মুখে ফেলতে পারে। হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরান সরাসরি কিংবা হিজবুল্লাহ ও হুথিদের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযান শুরু করতে পারে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা জানায়, এই হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’র শামিল বলে উল্লেখ করেছে দেশটির শীর্ষ নেতারা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, “আমরা এই আগ্রাসনের কঠিন জবাব দেব। ইসরায়েল তাদের এই হামলার পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞ নয়।”
ইরান ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের সমর্থিত মিলিশিয়াদের ‘উচ্চ সতর্কতা’ অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষণ: নতুন করে শুরু হতে পারে সংঘাত
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সামরিক অভিযান এবং কূটনৈতিক স্থাপনার বন্ধ ঘোষণা একটি বড় ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতির পূর্বাভাস হতে পারে। বহু দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি যেভাবে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে আবর্তিত হয়েছে, এই নতুন পরিস্থিতি সেই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলের তরফে বলা হয়েছে, ইরানের পরমাণু সক্ষমতা গড়ে ওঠার আগেই তা ধ্বংস করতে হবে। অন্যদিকে ইরান মনে করে, এই আগ্রাসন তাদের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি।
উপসংহার
ইসরায়েলের দূতাবাসগুলো বন্ধ করা এবং বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলি নাগরিকদের সতর্কতা জারি করার বিষয়টি এই বার্তাই দেয় যে, পরবর্তী কিছুদিন বিশ্ব রাজনীতি এবং কূটনৈতিক দিক থেকে অস্থির থাকবে। ইরান প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপে গেলে মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শক্তিগুলোর উচিত দ্রুত মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসা এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজা। না হলে এই সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বে অস্থিরতার আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে।