বিশ্ব

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচিত হলো নতুন পাঁচ দেশ

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২০২৬-২০২৭ মেয়াদের জন্য অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নতুন পাঁচটি দেশ নির্বাচিত হয়েছে। এই দেশগুলো হলো— বাহরাইন, কলম্বিয়া, কঙ্গো, লাটভিয়া ও লাইবেরিয়া। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে এই দেশগুলো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নিরাপত্তা পরিষদের মর্যাদাপূর্ণ এই সদস্যপদ লাভ করেছে।

নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সবচেয়ে প্রভাবশালী অঙ্গ, যার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বিশ্বজুড়ে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি এমন একমাত্র সংস্থা যেটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন, এবং সামরিক শক্তি ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। এদের প্রত্যেকের রয়েছে ভেটো ক্ষমতা, যার মাধ্যমে তারা যেকোনো প্রস্তাব আটকে দিতে পারে।

অস্থায়ী সদস্যদের গুরুত্ব ও নির্বাচন পদ্ধতি

নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে ১০টি দেশ অস্থায়ী সদস্য হিসেবে প্রতি দুই বছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়। প্রতি বছর পাঁচটি দেশ তাদের মেয়াদ শেষ করে এবং নতুন পাঁচটি দেশ সেই স্থান গ্রহণ করে। এই রোটেশন পদ্ধতির মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক প্রতিনিধি নিশ্চিত করা হয়।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর জন্য তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক গ্রুপে অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য রাষ্ট্রের ভোট অর্জন করা বাধ্যতামূলক। এবারের নির্বাচনে যে পাঁচটি দেশ নির্বাচিত হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে:

  • বাহরাইন পেয়েছে ১৮৬ ভোট
  • কঙ্গো পেয়েছে ১৮৩ ভোট
  • লাইবেরিয়া পেয়েছে ১৮১ ভোট
  • কলম্বিয়া পেয়েছে ১৮০ ভোট
  • লাটভিয়া পেয়েছে ১৭৮ ভোট

কারা জায়গা করে নিল এবং কারা স্থান হারাল

নির্বাচিত এই পাঁচটি দেশ স্থান গ্রহণ করবে বিদায়ী সদস্য আলজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ কোরিয়া, গায়েনা এবং স্লোভেনিয়ার জায়গায়। বিদায়ী দেশগুলো ২০২৪-২৫ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছে।

নির্বাচনে জয়ী হওয়া দেশগুলো জাতিসংঘের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছে। বাহরাইন মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিনিধি হিসেবে, কঙ্গো ও লাইবেরিয়া আফ্রিকা থেকে, কলম্বিয়া ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এবং লাটভিয়া ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে এই আসনগুলোতে বিজয়ী হয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদে নতুন সদস্যদের প্রাসঙ্গিকতা

নতুন নির্বাচিত দেশগুলো তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবশালী অবস্থান রাখে। এই দেশগুলোর নিরাপত্তা পরিষদে অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবে।

বাহরাইন: মধ্যপ্রাচ্যের এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি পারস্য উপসাগরীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইরান-সৌদি আরব উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বাহরাইনের নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থিতি এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

কঙ্গো ও লাইবেরিয়া: আফ্রিকার এই দুটি দেশ নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও উন্নয়ন ইস্যুতে জাতিসংঘে আগেও সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে কঙ্গো অতীতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় এই পরিষদে তাদের অন্তর্ভুক্তি তাৎপর্যপূর্ণ।

কলম্বিয়া: দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ ও শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময়ে কলম্বিয়া মানবাধিকার, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও মাদক পাচার প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। নিরাপত্তা পরিষদে তাদের অংশগ্রহণ এই ইস্যুগুলোর ওপর আরও মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে।

লাটভিয়া: ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এবং ন্যাটোর অংশ হওয়ায় লাটভিয়ার অন্তর্ভুক্তি রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের আলোকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বলকান ও পূর্ব ইউরোপীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তারা পরিষদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের নতুন প্রেসিডেন্ট

এছাড়াও, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বায়েরবোককে আগামী সেপ্টেম্বরে শুরু হতে যাওয়া ৮০তম অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করেছে। বায়েরবোক হচ্ছেন প্রথম জার্মান নারী যিনি এই পদে আসীন হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার ও টেকসই উন্নয়ন ইস্যুতে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ইতিবাচক সাড়া মিলছে।

প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর নতুন নির্বাচিত দেশগুলোর পক্ষ থেকে কূটনৈতিক পর্যায়ে শুভেচ্ছা ও দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার প্রকাশ করা হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নতুন সদস্যদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই নতুন সদস্যরা নিরাপত্তা পরিষদে বৈচিত্র্য, আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতা এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।”

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন এই পাঁচ সদস্যের অন্তর্ভুক্তি বিশ্ব রাজনীতিতে বর্তমান সংঘাত, অভিবাসন সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো ইস্যুতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসবে।

উপসংহার

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নতুন পাঁচটি দেশের নির্বাচন বৈশ্বিক কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি আরও বিস্তৃত করল। এই সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে— এমনটাই প্রত্যাশা করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button