চুয়াডাঙ্গায় আজ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা: ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস

২০২৫ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেও তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে রেহাই নেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে। আজ ১০ মে, শনিবার, চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা—৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা কয়েকদিন ধরেই এই জেলাটি অতি তাপপ্রবাহের কবলে রয়েছে। এমন অবস্থায় জনজীবন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর নিশ্চিত করেছে, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে ‘অতি তাপপ্রবাহ’ বয়ে যাচ্ছে, যা চলমান মাসের মধ্যে অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ গরমপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কেমন পরিস্থিতি চুয়াডাঙ্গায়?
চুয়াডাঙ্গায় দিনের বেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে উঠছে প্রতিদিনই। আজ ৪২ ডিগ্রি ছাড়ানোর পর শহরের রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার কার্যত ফাঁকা হয়ে পড়ে। দুপুরের পর থেকে রাস্তায় মানুষ চোখে পড়েছে হাতে গোনা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাপের তীব্রতায় প্রাণীকূল হাঁসফাঁস করছে। গবাদি পশুদের রাখালরা ঠাণ্ডা পানি ও ছায়ার ব্যবস্থা করেও তাদের স্বস্তি দিতে পারছেন না। নদী-খাল শুকিয়ে যাচ্ছে, পাতালে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার এক কৃষক বলেন,
“আমার গরুগুলা দুপুরে খেতে পারছে না, শুধু হাঁপাচ্ছে। মাঠে কাজও করা যাচ্ছে না, শরীরেই পানি থাকে না।”
মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব
- দিনমজুর, রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
- কর্মজীবী নারীরা কর্মক্ষেত্রে যেতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন।
- শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন ও শ্বাসকষ্টের অভিযোগ বাড়ছে।
- হাসপাতালে বাড়ছে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান,
“বিকেল বেলায় অনেক শিশু ও বয়স্ক রোগী আসছেন মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, প্রেসার পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যায়। এটা তীব্র গরমের সরাসরি প্রভাব।”
খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে
যেখানে অনেকেই ঘরে বসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সময় কাটাচ্ছেন, সেখানে খেটে খাওয়া মানুষরা পেটের দায়ে রোদে পুড়ে কাজ করছেন। তারা বলছেন, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়।
চুয়াডাঙ্গার এক ইটভাটা শ্রমিক বলেন,
“এই গরমে ইট টানতে টানতে শরীর ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে খাব কী?”
আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস: বৃষ্টি নেই আগামী ১৩ তারিখ পর্যন্ত
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আগামী ১৩ মে পর্যন্ত দেশে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং আরও কয়েকটি জেলায় তাপপ্রবাহ বাড়তে পারে।
বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর—এ সকল অঞ্চলে আগামী কয়েকদিন তাপমাত্রা ৪১-৪৩ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। রাজধানী ঢাকাতেও ৩৮-৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা বিরাজ করছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা: গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হতে পারে
পরিবেশবিদরা বলছেন, শুধু গরম বাড়ছে না, বরং গ্রীষ্মের মেয়াদও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এই প্রবণতা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব।
পরিবেশ বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন,
“বাংলাদেশে আগে এপ্রিল-মে পর্যন্ত তাপপ্রবাহ থাকত। এখন সেটা জুন পর্যন্ত গড়াচ্ছে। অনেক বছর ধরে গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, আর এই দীর্ঘ তাপপ্রবাহ কৃষি, স্বাস্থ্য এবং জলের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।”
সরকারি নির্দেশনা ও করণীয়
তীব্র গরমের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ক্লাস সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সুপারিশ এসেছে অনেক জেলা প্রশাসন থেকে। শিক্ষার্থীদের রোদের মধ্যে চলাফেরা করাতে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর দিয়েছে কিছু করণীয় নির্দেশনা:
- দুপুর ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত রোদে বাইরে না যাওয়া
- বেশি পানি পান করা
- হালকা সুতির জামা পরা
- শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন
- বাইরে কাজ করলে মাথায় টুপি বা ছাতা ব্যবহার
জরুরি করণীয়: এই গরমে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন
১. পানিশূন্যতা ঠেকাতে দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
২. যতটা সম্ভব ঘরে থাকুন, বিশেষ করে দুপুরে।
৩. ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ওআরএস খেতে পারেন।
৪. শিশু ও বৃদ্ধদের ঠাণ্ডা জায়গায় রাখুন।
৫. কোনো অস্বাভাবিক শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি একটি মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। যখন শহর, গ্রাম, খামার ও পরিবার—সব জায়গায় গরমের তীব্রতা দগ্ধ করছে মানুষকে, তখন শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, চাই পূর্ব প্রস্তুতি ও সচেতনতা।
আসন্ন দিনগুলোতে যদি আবহাওয়ার পরিবর্তন না হয়, তাহলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জীবনধারায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া ও জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার।