আবহাওয়া

বায়ুদূষণে বিশ্বে তৃতীয় ঢাকা: ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস

Advertisement

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আবারও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুইস পরিবেশ গবেষণা সংস্থা আইকিউএয়ার (IQAir)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ সোমবার (১০ নভেম্বর) সকাল পৌনে ৯টার সময় ঢাকার বায়ুর মান সূচক (AQI) রেকর্ড করা হয়েছে ২৬১, যা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর (Very Unhealthy)’ পর্যায়ে পড়েছে।

বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান

আইকিউএয়ারের ১০ নভেম্বর ২০২৫ সালের সকাল ৯টার তথ্য অনুযায়ী,

  • বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি, যার AQI স্কোর ৫৭৭।
  • দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর, যার স্কোর ৩১৩।
  • তৃতীয় স্থানে ঢাকা (বাংলাদেশ), স্কোর ২৬১।
  • চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতা, স্কোর ২০৩।
  • পঞ্চম স্থানে রয়েছে বসনিয়ার সারাজেভো, স্কোর ১৮১।

এই সূচক অনুযায়ী ঢাকা এখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণা ও গ্যাসের পরিমাণ এতটাই বেশি যে তা সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।

বায়ুর মান সূচক (AQI) কীভাবে মাপা হয়

বায়ুর মান সূচক (Air Quality Index) হলো একটি বৈজ্ঞানিক পরিমাপক পদ্ধতি, যা বাতাসে থাকা সূক্ষ্ম ধূলিকণা, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোনের ঘনত্ব নির্ধারণ করে।
আইকিউএয়ার-এর নির্ধারিত মান অনুযায়ী—

AQI স্কোরবায়ুর মানের ধরনস্বাস্থ্য প্রভাব
০–৫০ভালো (Good)নিরাপদ
৫১–১০০মাঝারি (Moderate)সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য সামান্য ঝুঁকি
১০১–১৫০সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকরশিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
১৫১–২০০অস্বাস্থ্যকর (Unhealthy)সকলের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
২০১–৩০০খুবই অস্বাস্থ্যকর (Very Unhealthy)স্বল্পমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, চোখ ও গলায় জ্বালাপোড়া
৩০১+বিপজ্জনক (Hazardous)জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা

ঢাকার বর্তমান সূচক ২৬১ হওয়ায় এটি ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এই পর্যায়ের বাতাসে দীর্ঘসময় অবস্থান করলে সুস্থ মানুষও শ্বাসকষ্ট, চোখে জ্বালা, গলা ব্যথা ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

ঢাকায় বায়ুদূষণের মূল কারণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের মূল কারণগুলো হলো—

  1. ইটভাটা: রাজধানীর চারপাশে হাজারো অবৈধ ইটভাটা থেকে প্রতিনিয়ত ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে।
  2. নির্মাণকাজের ধুলাবালি: চলমান সড়ক উন্নয়ন, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও ভবন নির্মাণকাজে প্রচুর ধূলিকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
  3. যানবাহনের ধোঁয়া: পুরনো ডিজেলচালিত বাস, ট্রাক ও লরির ধোঁয়া শহরের বাতাসকে সবচেয়ে বেশি দূষিত করছে।
  4. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব: খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানো এবং অপ্রতুল বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাও দূষণ বাড়াচ্ছে।
  5. গাছপালা ও সবুজের অভাব: নগরায়নের চাপে ঢাকায় সবুজ গাছপালা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে প্রাকৃতিক বায়ু পরিশোধন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কোটি মানুষ

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরের প্রায় ২ কোটি বাসিন্দা এখন প্রতিদিন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী ও শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই বায়ুদূষণ বিশেষভাবে বিপজ্জনক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শ্বাসযন্ত্র বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন,

“এই মাত্রার বায়ুদূষণ মানুষের ফুসফুসে ক্ষুদ্র কণিকা ঢুকিয়ে শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।”

তিনি পরামর্শ দেন—

  • প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বেরোতে,
  • বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে,
  • বাড়িতে এয়ার পিউরিফায়ার বা গাছপালা রাখতে,
  • পর্যাপ্ত পানি পান করতে এবং
  • ঘরে ধোঁয়া বা ধুলাবালি তৈরি হয় এমন কাজ এড়িয়ে চলতে।

সরকারি উদ্যোগ ও বাস্তবতা

পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) তথ্যমতে, রাজধানীতে বায়ুদূষণ রোধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ, পুরনো যানবাহন অপসারণ, নির্মাণস্থলে পর্দা ব্যবহার ও রাস্তা নিয়মিত পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে বাস্তবে এই উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন এখনো সন্তোষজনক নয়।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, নীতিমালা থাকলেও প্রয়োগ নেই—এটাই দূষণ রোধের প্রধান বাধা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন,

“ঢাকার বায়ুদূষণ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা শুধু পরিবেশ নয়, জাতীয় স্বাস্থ্য সঙ্কট তৈরি করছে। সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন কী বলছে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্যমতে, বায়ুদূষণ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি।
প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ দূষিত বাতাসের কারণে অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন।
এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো — ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান — সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,

“বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা যায় এবং দেশের জিডিপির প্রায় ৪% অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।”

ঢাকার বাতাস কেন এত খারাপ থাকে

ঢাকা এমন এক ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত, যেখানে বাতাসের চলাচল শীতকালে কমে যায়। ফলে ধোঁয়া ও ধুলিকণা উপরে উঠতে না পেরে শহরের উপরে স্তর তৈরি করে।
তাছাড়া, শীতকালে ইটভাটা ও যানবাহনের ধোঁয়া বেড়ে যায়, যা দূষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও সবুজায়নই ঢাকার বাতাস পরিষ্কার করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

জনসচেতনতা ও করণীয়

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও ভূমিকা অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেন—

  • খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে হবে,
  • পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে,
  • গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে,
  • স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা জোরদার করতে হবে।

পরিবেশ কর্মী আফসানা তাসনিম বলেন,

“প্রতিটি নাগরিক যদি নিজের আশপাশ পরিষ্কার রাখে এবং অন্তত একটি করে গাছ লাগায়, তবে ঢাকার বাতাস ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে।”

ঢাকার বায়ুদূষণ এখন শুধু একটি নগর সমস্যা নয়—এটি এক জাতীয় স্বাস্থ্য সংকট
প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ—সবই এখন এই দূষণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে,

“যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামী দশকে ঢাকায় বসবাস করা মানবজীবনের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।”

সুতরাং, সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে—
পরিবেশ বাঁচানো মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।

MAH – 13715 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button