বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এটি আরও শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
নিম্নচাপের অবস্থান ও গতিপথ
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে শনিবার সকালে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রটি ১০.৬ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে।
শনিবার সকাল ৬টায় এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ১,৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণে, কক্সবাজার বন্দর থেকে ১,২৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে, মোংলা থেকে ১,৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা বন্দর থেকে ১,২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এটি ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।
বাতাসের গতি ও সাগরের অবস্থা
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানতার সঙ্গে চলাচল করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের গভীর সমুদ্রে না যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সম্ভাব্য নাম ‘মন্থা’
আবহাওয়া দফতরের সূত্রে জানা গেছে, যদি নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়, তবে এর নাম হবে ‘মন্থা’। এই নামটি দিয়েছে থাইল্যান্ড। স্থানীয় ভাষায় ‘মন্থা’ শব্দের অর্থ সুগন্ধি ফুল বা সুন্দর ফুল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মৌসুমের প্রথম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। যদিও এর ল্যান্ডফল বা স্থলভাগে আঘাত হানার স্থান ও সময় এখনো স্পষ্ট নয়, তবে এটি বাংলাদেশের উপকূলের পরিবর্তে ভারতের পূর্ব উপকূলের দিকে যেতে পারে বলে প্রাথমিক পূর্বাভাসে ইঙ্গিত মিলেছে।
উপকূলে সতর্কতা ও প্রস্তুতি
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলো—বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায় বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার প্রভাব পড়তে পারে।
এছাড়া, আগামী তিন দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিও হতে পারে। আবহাওয়া অফিসের মতে, সাগরের উপর দিয়ে যাত্রা করা জাহাজ ও ট্রলারগুলোকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনগুলোকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সক্রিয় রাখার এবং আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।
পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টি ও বাতাসের প্রভাব
ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলেও এই নিম্নচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সোমবার থেকে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে দমকা বাতাস বইতে পারে।
মঙ্গলবার ও বুধবারের মধ্যে বৃষ্টি আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। এ সময় সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে জলোচ্ছ্বাস ও নদীপাড়ে ভাঙনের আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকায় এই লঘুচাপ দ্রুত ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও শক্তি উভয়ই বেড়ে গেছে।
জলবায়ু গবেষকরা বলছেন, অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে গঠিত ঘূর্ণিঝড়গুলো সাধারণত উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রভাব ফেলে। তাই এখনই প্রস্তুতি জোরদার করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা নির্ভর করে এর পথ, গতি ও সাগরের উষ্ণতার ওপর। তাই পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।”
প্রস্তুতি
বাংলাদেশ প্রতিবছরই বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিত্রাং, মোখা, আম্পান ও বুলবুলসহ একাধিক ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে।
সরকারি সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার ঘোষণা দিয়েছে। সিভিল ডিফেন্স, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসন উপকূলের জনগণকে সচেতন করতে প্রচারণা শুরু করেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উপকূলীয় জেলাগুলিতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা এবং জরুরি খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সামগ্রী মজুতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে গঠিত নিম্নচাপটি এখন নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা আরও বাড়তে পারে। আবহাওয়া অফিস বলছে, এটি দেশের উপকূলে সরাসরি আঘাত না হানলেও ভারী বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হবে। আপাতত উপকূলীয় জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এম আর এম – ১৯৩৩,Signalbd.com



