প্রযুক্তি

মহাকাশে নতুন ১২০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি গুচ্ছের সন্ধান

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ধরা পড়ল বিগ ব্যাংয়ের পরবর্তী সময়ের ছায়াপথের বিরল চিত্র

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গহীন অন্ধকারে আরেকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেন বিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের (JWST) মাধ্যমে পৃথিবী থেকে প্রায় ১২০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে একটি বৃহৎ ছায়াপথগুচ্ছ (Galaxy Cluster) শনাক্ত করা হয়েছে। এই ছায়াপথগুচ্ছে অন্তত ১,৬৭৮টি গ্যালাক্সির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা এখন পর্যন্ত একই অঞ্চলে দেখা পাওয়া বৃহত্তম ও প্রাচীনতম গ্যালাক্সি গুচ্ছের একটি।

এই চমকপ্রদ আবিষ্কার মহাবিশ্বের জন্ম, গঠন এবং বিবর্তনের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

‘COSMOS-Web’ অঞ্চলে গ্যালাক্সির মিলনমেলা

নতুন শনাক্ত হওয়া গ্যালাক্সিগুলো অবস্থান করছে মহাকাশের ‘কসমস-ওয়েব’ (COSMOS-Web) নামে পরিচিত এক বিশাল অঞ্চলে। এই অঞ্চলটিকে আগে থেকেই গভীর পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন গবেষকরা। এই গুচ্ছটি এতই বিশাল এবং ঘনবসতিপূর্ণ যে বিজ্ঞানীরা এটিকে “মহাজাগতিক শহর” বা ‘Cosmic City’ বলে অভিহিত করছেন।

ফিনল্যান্ডের আল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী গাসেম গোজালিয়াসল বলেন,

“আমরা মহাবিশ্ব গঠনের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ের কিছু গ্যালাক্সি এবার সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এই প্রথম এত গভীরতায়, এত প্রাচীন সময়কার গ্যালাক্সি গুচ্ছ শনাক্ত করা সম্ভব হলো।”

ডার্ক ম্যাটার, কৃষ্ণগহ্বর ও উত্তপ্ত গ্যাসে ভরপুর এই গ্যালাক্সি গুচ্ছ

এই গ্যালাক্সিগুলো শুধু তারকা, গ্যাস ও ধূলিকণার সমাবেশ নয়; বরং এতে রয়েছে ডার্ক ম্যাটার (অদৃশ্য বস্তু), হাই-টেম্পারেচার গ্যাস, এবং বহু বিশাল কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole)। এর মধ্যে কয়েকটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, যা গ্যালাক্সিগুলোর গঠন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই গ্যালাক্সিগুলো যে ধরনের গুচ্ছ গঠন করেছে, তাকে “প্রোটো-ক্লাস্টার (Proto-Cluster)” বলা হয়। এ ধরনের গুচ্ছ হলো সেই মহাজাগতিক কাঠামো, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে রূপান্তরিত হয়।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ: মহাবিশ্ব অন্বেষণের নতুন দুয়ার

২০২১ সালে উৎক্ষেপণের পর থেকেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) বিশ্বখ্যাত হয়ে উঠেছে তার অসাধারণ ইমেজিং ক্ষমতা ও ইনফ্রারেড রেঞ্জে কাজ করার ক্ষমতার জন্য। এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩০০-৪০০ মিলিয়ন বছর পর পর্যন্ত সময়ের ছায়াপথও দেখতে পাচ্ছেন।

COSMOS-Web প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. জোয়েল লেগ বলেন,

“এটি পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের এবং সবচেয়ে প্রাচীন গ্যালাক্সি গুচ্ছগুলোর একটি। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কীভাবে গ্যালাক্সিরা একত্রিত হয়ে বড় বড় গুচ্ছ তৈরি করেছে, এবং মহাবিশ্বে বস্তু ও শক্তির বণ্টন ঠিক কেমন ছিল।”

গ্যালাক্সির বিবর্তন জানাবে অতীতের চাবিকাঠি

নতুন আবিষ্কৃত এই গ্যালাক্সিগুলো প্রায় ১২০০ কোটি বছর আগের, অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের তুলনামূলক প্রাথমিক সময়ের। সেই সময় মহাবিশ্ব অনেক ছোট, ঘন এবং উত্তপ্ত ছিল। এই ছায়াপথগুলো ঠিক কেমনভাবে একত্রিত হয়েছে, কীভাবে তারা তারকা উৎপাদন করেছে, কোন ধরণের কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়েছে — এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন,

“এই গ্যালাক্সিগুলোর জীবনচক্র, গঠন ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে আমরা মহাবিশ্বের বিবর্তনের এক বিস্তারিত ইতিহাস রচনা করতে পারবো।”

এখনও গবেষণা চলছে — প্রকাশ হবে অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস জার্নালে

গবেষণার পূর্ণ প্রতিবেদন ‘Astronomy & Astrophysics (A&A)’ নামের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এই জার্নালে মহাকাশবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো নিয়মিত প্রকাশ করা হয়।

অপূর্ব সম্ভাবনা: ভবিষ্যতে মহাকাশ অভিযানে সহায়ক তথ্য

এই নতুন গ্যালাক্সি গুচ্ছের ডেটা কেবল বিজ্ঞানের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা কীভাবে ভবিষ্যতে নতুন গ্রহ, নতুন উপগ্রহ বা বাসযোগ্য অঞ্চল খুঁজব—তাতে এমন গ্যালাক্সি মানচিত্র গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতে পারে।

গ্যালাক্সি গুচ্ছ কী? সংক্ষেপে জানুন

  • গ্যালাক্সি (ছায়াপথ): তারকা, গ্যাস, ধূলিকণা, ডার্ক ম্যাটার ইত্যাদির সমষ্টি। যেমন আমাদের মিল্কি ওয়ে (Milky Way)।
  • গ্যালাক্সি গুচ্ছ (Galaxy Cluster): শত শত গ্যালাক্সির সমাহার।
  • প্রোটো-ক্লাস্টার (Proto-cluster): মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত গ্যালাক্সি গুচ্ছ, যেগুলো পরবর্তীতে বড় আকার ধারণ করে।

সংক্ষেপে মূল পয়েন্ট

বিষয়তথ্য
আবিষ্কারের স্থানCOSMOS-Web অঞ্চল
দূরত্বপ্রায় ১২০০ কোটি আলোকবর্ষ
ছায়াপথ সংখ্যা১,৬৭৮টির বেশি
প্রযুক্তিজেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
বৈশিষ্ট্যডার্ক ম্যাটার, হাই টেম্পারেচার গ্যাস, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল
গবেষণা প্রকাশAstronomy & Astrophysics জার্নালে প্রকাশ হবে
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button