অর্থনীতি

ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্য এশীয় দেশগুলো, কে জিতছে

Advertisement

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণা এশিয়ার দেশগুলোকে গভীর উদ্বেগে ফেলেছে। বিশেষ করে জাপানসহ অনেক দেশ এই শুল্ক আরোপকে ‘দুঃখজনক’ এবং ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে অভিহিত করেছে। এই শুল্ক যুদ্ধ কি কেবল আমেরিকার একতরফা সিদ্ধান্ত, নাকি এতে বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হতে যাচ্ছে? আসুন বিস্তারিত জানি।

ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা: মূল পয়েন্টসমূহ

২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে ট্রাম্প সরকার একের পর এক দেশ ও পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেছে। তার সর্বশেষ পদক্ষেপে জাপানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হচ্ছে। এ ছাড়াও কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ ২৩টি দেশের পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপের নোটিফিকেশন পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি দেশ এশিয়ার।

ট্রাম্পের কথায়, “সব দেশকে এখন থেকে অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। আমরা এই বিষয়টি খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করব।” এর পাশাপাশি তিনি জানান, মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি এই শুল্ক আরোপে আপস করবেন না।

জাপানের প্রতিক্রিয়া: ‘গভীর দুঃখ’ ও বাণিজ্য সংঘাত

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এই শুল্ক ঘোষণা ‘গভীর দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। জাপান বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও এই শুল্ক যুদ্ধে তাদের অবস্থা কঠিন হয়ে উঠেছে। জাপানের গাড়ি শিল্প ইতোমধ্যেই সংকটগ্রস্ত, আর নতুন শুল্কে তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষ করে চাল আমদানিতে তারা মার্কিন চাপে পড়লেও নিজেদের কৃষি বাজার মুক্ত করতে রাজি হয়নি। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে বহুবার আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনও সমঝোতায় পৌঁছানো যায়নি। ট্রাম্প আগে জাপানকে ‘দুর্ধর্ষ’ বললেও এখন অভিযোগ করছেন যে জাপান সহযোগিতা করছে না।

শুল্ক আরোপের প্রভাব: এশিয়ার অর্থনীতির ওপর প্রভাব

দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা সহ এশিয়ার অনেক দেশই রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি। ট্রাম্পের এই শুল্ক কৌশল তাদের শিল্প ও বাণিজ্যে বড় ধাক্কা দিতে পারে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, পোশাকশিল্প ও নির্মাণ খাতগুলো যেখানে আমেরিকান বাজারে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই শুল্ক যুদ্ধ শুধু আমেরিকা ও এশিয়া নয়, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এই পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়বে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ক্যাপরি বলেছেন, “বাণিজ্য চুক্তিগুলো এত জটিল এবং স্পষ্ট নয় যে, সব দেশ তাদের প্রস্তুতি নিতে পারছে না। ট্রান্সশিপমেন্ট শুল্কের নিয়মাবলি কীভাবে প্রয়োগ হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে।”

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র: বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় এশিয়ার ভূমিকা

এশিয়ার ময়দানে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। ট্রাম্পের এই নতুন শুল্ক কৌশলে চীন কিছুটা সুযোগ পেয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। কারণ, আমেরিকা যখন একাধিক দেশকে শুল্কে বেঁধে দেয়, তখন চীন প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে শক্ত অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে।

তবে চীনও যে সহজে বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না, তার প্রমাণ রয়েছে। কারণ, অনেক এশীয় দেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না হওয়ার পাশাপাশি মার্কিন বাজার থেকেও বিচ্ছিন্ন হতে চায় না।

ভারতের অবস্থান: এখনও অপেক্ষার পালা

ভারত এখনো মার্কিন শুল্ক চিঠি পাননি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কৃষি খাত ও আমদানির নিয়ম নিয়ে বেশ কিছু দ্বন্দ্ব রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে একটি স্থায়ী বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যদি এভাবে টানাপোড়েনে থেকে যায়, তবে এর প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতেও পড়বে।

ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও বিশ্ব বাণিজ্যের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাণিজ্য সংঘাত ‘কে জিতল, কে হারল’ হিসাব করার চেয়ে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বুঝতে হবে। যদিও কিছু দেশ অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে বেশি সময় নিতে পারবে, তবুও এ ধরনের শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ধাক্কা দেবে।

বিশেষ করে আগামী আগস্টের মধ্যে পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হবে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ট্রাম্প ১ আগস্টের মধ্যে দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসার কথা বলেছেন, নতুবা কঠোর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।

জাপানের বিশেষ প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

জাপান ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। ট্রাম্পের এপ্রিল মাসের ঘোষণার পরপরই টোকিও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ব্যবসায়িক সহায়তা কেন্দ্র চালু করেছে। তবে জাপানের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংসদের উচ্চকক্ষ নির্বাচন। এজন্য আগস্টের মধ্যে কোন চূড়ান্ত সমঝোতা হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

জাপানের কৃষি খাতের সুরক্ষায় তারা মার্কিন চাল আমদানি করতে রাজি হয়নি এবং সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মার্কিন দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে, যা দুই দেশের মধ্যে নতুন টান তৈরি করেছে।

ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ: কে জিতবে, কে হারাবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক কৌশল থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে না। কিন্তু এর ফলে চীনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, এবং বহু দেশ নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করছে।

তবে এই যুদ্ধের মাঝেই যে কোনও দেশ সুবিধাভোগী হবে, তা নিশ্চিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্বের এই পরিণতি বিশ্ব অর্থনীতির নতুন ধারা গড়ে দিতে পারে, যার প্রভাব দেখা যাবে আগামী কয়েক দশকে।

সারসংক্ষেপ

  • ট্রাম্পের নতুন শুল্ক এশিয়ার ১৪টি দেশসহ মোট ২৩টি দেশকে লক্ষ্য করে আরোপিত হচ্ছে।
  • জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
  • শুল্ক আরোপে বিভ্রান্তি ও জটিলতা রয়েছে, বিশেষ করে ট্রান্সশিপমেন্ট সংক্রান্ত নিয়মাবলীতে।
  • চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ এশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
  • ভারত এখনও চিঠি পায়নি, তবে কৃষি ও আমদানির বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে।
  • আগস্টের মধ্যে সমঝোতা না হলে কঠোর শুল্ক আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে।
  • জাপান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে শুল্ক নিয়ে কঠিন অবস্থানে।

কীভাবে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশে?

বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি হলে এই শুল্ক যুদ্ধ থেকে অক্ষত থাকা কঠিন। ইলেকট্রনিকস, পোশাক ও বস্ত্র শিল্পে আমেরিকান বাজার গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মূল্য বাড়তে পারে, রপ্তানি কমতে পারে এবং কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ীরা এখন পরিস্থিতি নজরদারি করছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সিঙ্গলবিডি ডট কমে পড়ুন সবশেষ ও বিশ্লেষণধর্মী বাণিজ্য সংবাদ।
আপডেটের জন্য ফলো করুন, শেয়ার করুন।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button