বদলে যাচ্ছে দেশের টেলিকম ব্যবস্থা

দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সেবা উন্নত করতে বড় ধরনের সংস্কারে যাচ্ছে সরকার। মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট সেবায় স্বচ্ছতা আনতে ২২ ধরনের লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কমিয়ে তিনটি স্তরে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে ‘নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং রেজিম রিফর্ম পলিসি ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে।
বিটিআরসি’র পরিকল্পনায় টেলিকম খাতে বিদ্যমান অগোছালো লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে সরলীকরণ করা হবে। ফলে অপ্রয়োজনীয় লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও সেবার দিক থেকে শক্তিশালী একটি অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রত্যাশা করছে সরকার।
বিদ্যমান লাইসেন্সিং চিত্র
বর্তমানে দেশে মোবাইল অপারেটর, ব্রডব্যান্ড সেবাদাতা, আইজিডব্লিউ, আইআইজি, এনটিটিএন, নিক্স ও আইসিএক্সসহ ২২ ধরনের লাইসেন্স বিদ্যমান। ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে সাবমেরিন কেবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) থেকে ব্যান্ডউইডথ এনে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এর মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ পৌঁছাতে সহায়তা করে এনটিটিএন অপারেটররা। অন্যদিকে, মোবাইল নেটওয়ার্কের বিস্তারে অবদান রাখছে টাওয়ার কোম্পানিগুলো।
মোবাইলে কল আদান-প্রদান আইসিএক্সের মাধ্যমে হয়ে থাকে, আর আইএসপিগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট ডেটা আদান-প্রদান হয় ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (নিক্স) প্ল্যাটফর্মে।
পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী জানান, অতীতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সেবা ও লাইসেন্স সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর ফলে খাতটিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যা আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, “ভিওআইপি (ভয়েস ওভার আইপি) সেবাকে এক ধরনের প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল, যা টেলিকম খাতের জন্য ক্ষতিকর ছিল। এখন সময় এসেছে এ খাতকে আধুনিক ও ব্যবসা-বান্ধব কাঠামোয় নিয়ে আসার।”
নতুন লাইসেন্সিং কাঠামো
নতুন নীতিমালায় আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স ও নিক্স লাইসেন্স বাতিলের প্রস্তাব রয়েছে। এগুলোর সেবা এখন মোবাইল অপারেটর ও আইএসপিদের মাধ্যমে সরবরাহের সুযোগ থাকবে। এর ফলে বাজারের প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং সেবা আরও দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া, কল সেন্টার, ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং এবং টি-ভ্যাস সেবার জন্য আলাদা লাইসেন্সের প্রয়োজন থাকবে না। তবে বিশেষ ক্যাটাগরির সেবা হিসেবে স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা আলাদা ভাবে অনুমোদন পাবে।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার সাহেদ আলম বলেন, “চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিটিআরসি যে নতুন লাইসেন্সিং ফ্রেমওয়ার্ক দিচ্ছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও ইতিবাচক।”
উদ্বেগ ও সমালোচনা
তবে, এই পরিবর্তন নিয়ে কিছু অংশের উদ্বেগও রয়েছে। আইজিডব্লিউ অপারেটররা মনে করছেন, তাদের জন্য ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ থাকছে না। আইজিডব্লিউ অপারেটরস ফোরামের সভাপতি আসিফ রাব্বানী বলেন, “আমরা মনে করি, এই নীতির মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাদ দিয়ে সার্ভিস বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।”
আইআইজিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, “আমরা চাই, চূড়ান্ত নীতিতে বিটিআরসি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”
বর্তমানে দেশে ২৪টির মতো আইজিডব্লিউ অপারেটর আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান করছে। তাদের দাবি, নতুন নীতিমালায় উপযুক্ত বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া এই অপারেটরদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা দেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
বিটিআরসি’র পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন লাইসেন্সিং কাঠামো তিনটি ধাপে ২০২৭ সালের মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে। প্রথম ধাপে লাইসেন্সের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে, দ্বিতীয় ধাপে প্রযুক্তি ও সেবার সংমিশ্রণে বাজারকে প্রস্তুত করা হবে, এবং তৃতীয় ধাপে চূড়ান্তভাবে নতুন লাইসেন্সিং মডেল কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রিফর্ম কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের টেলিকম খাতে নতুন যুগের সূচনা হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সকল অংশীজনের স্বার্থ রক্ষা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন।
উপসংহার
দেশের টেলিকম খাতকে আরও গতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক করতে বিটিআরসি’র উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের উদ্বেগ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে নীতিমালার চূড়ান্ত রূপ দেওয়া উচিত। স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিচালিত হলে, এ সংস্কার দেশের ডিজিটাল উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে।