ফেসবুকের ২২ বছরের যাত্রা: হার্ভার্ডের ডরমিটরি থেকে বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগের বিপ্লব

২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোট ডরমিটরিতে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘দ্য ফেসবুক’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। শুরুতে এটি হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও দ্রুতই বোস্টনের অন্যান্য কলেজ, আইভি লিগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে, ফেসবুক বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে।
শুরুটা কেমন ছিল
হার্ভার্ডে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ তাঁর সহপাঠী অ্যাডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিজ এবং ক্রিস হিউজকে সঙ্গে নিয়ে ‘দ্য ফেসবুক’ তৈরি করেন। শুরুতে তাঁরা এক হাজার ডলার করে বিনিয়োগ করেন। প্রথমে এটি হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, দ্রুতই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৫ সালের মধ্যে ফেসবুকের সদস্যসংখ্যা ৬০ লাখ অতিক্রম করে।
বৈশ্বিক সম্প্রসারণ ও প্রভাব
ফেসবুকের দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে এটি বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে মিসর, সিরিয়া এবং তিউনিসিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলনে ফেসবুকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এটি সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে এবং তথ্য প্রচারে সহায়তা করে।
ফিচার ও সেবার বিবর্তন
ফেসবুকের সাফল্যের পেছনে এর নিয়মিত ফিচার আপডেট এবং নতুন সেবা সংযোজনের ভূমিকা অপরিসীম। ২০০৬ সালে ‘নিউজ ফিড’ ফিচারটি চালু হয়, যা ব্যবহারকারীদের বন্ধুদের আপডেট সহজে দেখতে সহায়তা করে। পরবর্তীতে ‘লাইক’ বাটন এবং তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ্লিকেশন সংযোজনের মাধ্যমে ফেসবুক আরও সমৃদ্ধ হয়। এছাড়া, ২০০৭ সালে ফেসবুক অ্যাডস চালুর মাধ্যমে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
অধিগ্রহণ ও কর্পোরেট পরিবর্তন
ফেসবুক তার সেবার পরিধি বাড়াতে এবং ব্যবহারকারীদের আরও সুবিধা দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেছে। ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম এবং ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে ফেসবুক তার সেবার পরিসর বাড়ায়। ২০২১ সালের অক্টোবরে কর্পোরেট রিব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে ফেসবুক তার নাম পরিবর্তন করে ‘মেটা’ রাখে, যা মেটাভার্সের প্রতি তাদের আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
সমালোচনা ও বিতর্ক
ফেসবুকের যাত্রা শুধুমাত্র সাফল্যে ভরা নয়; বিভিন্ন সময়ে এটি সমালোচনা ও বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির ফলে ফেসবুকের তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ঘটনায় কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য অননুমোদিতভাবে সংগ্রহ ও ব্যবহার করা হয়েছিল, যা বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে ফেসবুকের ব্যবহারকারী সংখ্যা ৩০০ কোটিরও বেশি। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বাড়লেও, ফেসবুক এখনও বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মেটা প্রতিষ্ঠানটি মেটাভার্সের দিকে মনোযোগ দিয়ে ভবিষ্যতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটির মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে।
বাংলাদেশে ফেসবুকের প্রভাব
বাংলাদেশে ফেসবুক অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ব্যবসা, শিক্ষা এবং সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রচারসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
হার্ভার্ডের একটি ছোট ডরমিটরি থেকে শুরু হওয়া ফেসবুকের যাত্রা আজ বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগের ধারণাকে পরিবর্তন করেছে। সাফল্য, সমালোচনা এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ফেসবুক তার অবস্থান ধরে রেখেছে এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন সেবা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে সংযুক্ত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।