প্রযুক্তির অগ্রগতির নতুন যুগে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে চিপ, অ্যালগরিদম বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু আগামী দশকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে—বিদ্যুৎ। হ্যাঁ, প্রযুক্তির এই দ্রুত পরিবর্তনের সময়ে বিদ্যুৎ হচ্ছে সেই সীমা, যা পুরো ইকোসিস্টেমকে প্রভাবিত করবে।
বিশাল ডেটা সেন্টার ও এআই-চালিত প্রতিষ্ঠানগুলো এমন এক অবকাঠামোর জন্য আগাম গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনছে, যা এখনও পুরোপুরি উপলব্ধ নয়। দেশগুলো জোরেশোরে সাবস্টেশন এবং ট্রান্সমিশন করিডর অনুমোদন করছে। এই প্রেক্ষাপটে আবার আলোচনায় এসেছে এক পরিচিত শক্তির নাম—পারমাণবিক শক্তি।
প্রযুক্তির সীমারেখা: বিদ্যুৎ এখন সবচেয়ে বড় বাধা
অতীতের পঞ্চাশ বছরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আতঙ্কের মাঝামাঝি। খরচ, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্কিত। তবে এখন এআই-উদ্ভাবনের যুগে সেই সমীকরণ বদলে গেছে। বিশাল ডেটা সেন্টারের চাহিদা শুধুমাত্র পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করছে না, অর্থনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকেও এটি অপরিহার্য।
শিল্পযুগের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। রাজনীতিবিদরা জিপিইউ, মডেলের আকার ও কম্পিউটিং সার্বভৌমত্ব নিয়ে তর্ক করলেও বাস্তবের প্রযুক্তি নির্ধারণ করছে—মেগাওয়াট, মাইক্রোচিপ নয়।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) জানিয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যেই বৈশ্বিক ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই কয়েক বছরের মধ্যে আরও কয়েক ডজন গিগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে, যা কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের মোট বিদ্যুতের সমপরিমাণ। মূল কারণ—এআই এবং ক্লাউড কম্পিউটিং।
পুনর্জাগ্রত পারমাণবিক শক্তি
যে পারমাণবিক শক্তিকে ধীর, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে খারিজ করা হতো, সেটি এখন আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশাল ডেটা সেন্টারের নির্ভরযোগ্য, কার্বনমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এটি কার্যকর সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।
মূল পরিবর্তন প্রযুক্তিগত নয়, মানসিক। কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার, পারমাণবিক শক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে সরকার নয়, সফটওয়্যার কোম্পানি।
যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে ‘রিস্টার্ট বিপ্লব’।
- আইওয়ার ডুয়েন আর্নল্ড এনার্জি সেন্টার: ২০২০ সালে বন্ধ হয়েছিল, এবার গুগল ও নেক্সটএরার চুক্তিতে পুনরায় চালু হচ্ছে।
- মিশিগানের পালিসেডস প্লান্ট: ২০২৫ সালের মধ্যে পুনরায় সচল হতে পারে।
- মাইক্রোসফট ও থ্রি মাইল আইল্যান্ড প্লান্ট: পুনরায় চালু করার চুক্তি হয়েছে।
- মেটা ও ইলিনয়: ১.১ গিগাওয়াট ক্ষমতার একটি প্ল্যান্ট পুনরায় শুরু হচ্ছে।
এসব প্রকল্পের সাফল্য প্রযুক্তির উপর নয়, অভিজ্ঞ কর্মী ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপত্যে নির্ভর করছে।
নীতিগত বাধা: প্রযুক্তি নয়, প্রশাসন
যাই হোক, মূল বাধা প্রযুক্তিগত নয়। এটি নীতিগত। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এনআরসি) এখনো এমন কোনো কাঠামো তৈরি করেনি যা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্লান্টকে পুনরায় চালু করার অনুমতি দেয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন নিয়ম নতুন নির্মাণের জন্য তৈরি, পুনরুজ্জীবনের জন্য নয়। ফলে সময় হয়ে যাচ্ছে কৌশলগত দুর্বলতা।
নতুন প্রজন্মের উন্নত রিঅ্যাক্টর, যেমন কাইরোস পাওয়ার থেকে টেরাপাওয়ার, ছোট, মডুলার এবং ডেটা সেন্টার ও শিল্পকেন্দ্রের পাশে বসানোর উপযোগী।
উদাহরণস্বরূপ:
- ওকলো ডেটা সেন্টার: ১২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি।
- ক্রুসো ব্লু এনার্জি, টেক্সাস: ১.৫ গিগাওয়াট পারমাণবিক চালিত ডেটা সেন্টার।
এখানেও সময়ই বড় প্রতিপক্ষ। একটি ডেটা সেন্টার তৈরি হয় দেড় বছরে, কিন্তু একটি রিঅ্যাক্টর বানাতে লাগে দশ বছর। তাই পারমাণবিক শক্তিকে ডিজিটাল গতিতে চলতে শিখতে হবে—মডুলার নির্মাণ, পূর্বনির্ধারিত অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং স্থায়ী অর্থায়নের মাধ্যমে।
প্রশাসনিক বিভাজন: বিদ্যুৎ ও নীতি
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নীতি পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না।
- মার্কিন জ্বালানি বিভাগ: নতুন প্রযুক্তিতে অর্থায়ন দেয়, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয় না।
- এনআরসি: নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সময়সীমা নয়।
- ফেডারেল এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (FERC): ট্রান্সমিশন পরিচালনা করে, কিন্তু কম্পিউটিং পরিকল্পনা নয়।
ফলে, ডেটা সেন্টারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে প্রশাসনিক কাঠামোর সমন্বয় নেই।
পারমাণবিক শক্তি: স্থিতিশীল, কার্বনমুক্ত, অনন্য
জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ভগল পারমাণবিক ইউনিট প্রমাণ করছে, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে স্থিতিশীল, কার্বনমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। কিন্তু সতর্ক সংকেতও আছে।
যদি নীতি সংস্কার না হয়, এআইয়ের বিদ্যুৎ চাহিদা পড়বে সাধারণ মানুষের কাঁধে, আর বেসরকারি চুক্তি থেকে লাভ হবে সীমিত কোম্পানির পকেটে। মেরিল্যান্ডের ট্রান্সমিশন জট, টেক্সাসের অস্থিরতা, ক্যালিফোর্নিয়ার ঘাটতি—সবই ইঙ্গিত দেয়, ডিজিটাল প্রবৃদ্ধি যদি গ্রিড নীতির চেয়ে দ্রুত হয়, বিপদ আসবেই।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
সুসংবাদ হলো, যুক্তরাষ্ট্রকে ফিউশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আগামী এক দশকে বন্ধ প্লান্ট পুনরায় চালু, মডুলার রিঅ্যাক্টর স্থাপন ও স্মার্ট নীতির মাধ্যমে আরও কয়েক ডজন গিগাওয়াট পরিষ্কার, স্থিতিশীল বিদ্যুৎ যোগ করা সম্ভব।
ফিউশন প্রযুক্তি অবশ্যই একদিন আসবেই, তবে চলতি এআই বিপ্লবের জন্য বিশ বছর অপেক্ষা করা যায় না। পারমাণবিক শক্তি হয়তো জিপিইউ-এর মতো ঝকঝকে নয়, কিন্তু এটি ঘুমায় না।
ওয়াশিংটন যদি চায়, যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী এআই সমৃদ্ধির যুগে নেতৃত্ব দিক, তবে তাকে পরিষ্কার ও স্থিতিশীল বিদ্যুতের গুরুত্ব দিতে হবে, যেমনটা চিপ ও কোডকে দেয়। ডেটা সেন্টারই নতুন কারখানা, পারমাণবিক শক্তি প্রস্তুত, এগুলো চালানোর জন্য।
MAH – 13690 I Signalbd.com



