প্রযুক্তি

জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করলে ব্লক করা হবে ওয়েবসাইট

Advertisement

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া ও বেটিং বিজ্ঞাপন বন্ধে সরকার আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আগামীকাল ১৯ অক্টোবর থেকে যদি কোনো সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ, নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা অন্য কোনো ওয়েবসাইটে জুয়া, বেটিং বা পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত কোনো ধরনের কনটেন্ট বা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, তবে বিনা নোটিশে সেই সাইট ব্লক করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

আজ শনিবার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক সরকারি বিবৃতিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

সরকারের কঠোর নির্দেশনা

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে দেশের কিছু অনলাইন সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ, মোবাইল অ্যাপ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে জুয়া, বেটিং ও পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনাল ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম কেবল অবৈধই নয়, বরং সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-এর সরাসরি লঙ্ঘন। এই আইন অনুযায়ী এমন কার্যক্রম দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলেছে, “সরকার বারবার সতর্কতা জারি করেও কিছু প্রতিষ্ঠান এই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার অব্যাহত রেখেছে। তাই এবার কোনো পূর্বনোটিশ ছাড়াই সেই ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দেওয়া হবে।”

ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা

সরকারের নির্দেশনার পর ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের বিজ্ঞাপন নীতি সংশোধন করেছে। ক্রিকইনফো, জনকণ্ঠ, ঢাকা পোস্টসহ আরও কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে আসা বিজ্ঞাপন পরিবর্তন করেছে। মন্ত্রণালয় তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছে।

সরকার মনে করছে, দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমগুলো যদি নৈতিক মান বজায় রাখে, তবে ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

সাইবার নিরাপত্তা রক্ষায় একসাথে কাজ করছে একাধিক সংস্থা

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের অনলাইন পরিসরকে নিরাপদ ও নৈতিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)
  • অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)
  • জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি (এনসিএসএ)
  • জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি)
  • জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)
  • বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)

এই সব সংস্থা মিলে জুয়া, বেটিং ও পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত ওয়েবসাইট এবং অ্যাপগুলো চিহ্নিত করছে এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।

অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের ভয়াবহ প্রভাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন জুয়া ও বেটিং বিজ্ঞাপন শুধু নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ নয়, বরং তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে। অনেক সময় বিনোদনের আড়ালে এইসব প্ল্যাটফর্ম তরুণদের আসক্ত করে ফেলছে, যার পরিণতি হয় ঋণগ্রস্ততা, পারিবারিক অশান্তি এবং মানসিক অবসাদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিমা হক বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে কিশোর-কিশোরীরাও এসব লিঙ্কে ক্লিক করছে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি।”

কেন এত কঠোর হচ্ছে সরকার

বাংলাদেশে জুয়া দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত। তবে ডিজিটাল যুগে জুয়ার রূপ বদলেছে। আগে যেখানে জুয়া হতো গোপনে বা ক্লাব-ভিত্তিক, এখন সেটি চলে এসেছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের পর্দায়।

“বেটিং সাইট”, “ক্যাসিনো গেম”, “লাইভ স্পোর্টস বেট” — এসব নামেই বিদেশি কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বাংলাদেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। অনেক সময় সাধারণ ওয়েবসাইট মালিকরাও বুঝতে পারেন না যে তারা অনৈতিক কনটেন্ট প্রচার করছেন, কারণ এসব বিজ্ঞাপন অটোমেটিক গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়

তবে সরকার বলছে, অজুহাত নয়, সতর্কতা জরুরি। বিজ্ঞাপন চালানোর আগে ওয়েবসাইট মালিকদের নিশ্চিত হতে হবে যে কোনো অবৈধ বা আপত্তিকর কনটেন্ট যেন না থাকে।

বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি সতর্কবার্তা

মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে শুধু মিডিয়া নয়, বরং বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি জুয়া বা বেটিং সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বা অ্যাপের প্রচারণা চালায়, তবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিটিআরসি ইতোমধ্যেই একাধিক আন্তর্জাতিক বেটিং সাইট যেমন 1xBet, BetWinner, Bet365, Melbet, Parimatch প্রভৃতি ব্লক করেছে। তবে নতুন ডোমেইন খুলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও দেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। সেই কারণেই সরকারের নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।

নাগরিকদের ভূমিকা ও সতর্কতা

সরকার জনগণকেও আহ্বান জানিয়েছে, কেউ যদি কোনো ওয়েবসাইটে জুয়া বা বেটিং সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখে, তবে সেটি যেন অবিলম্বে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে রিপোর্ট করে।

এনসিএসএ ও সিআইডি’র ওয়েবসাইটে এখন এমন রিপোর্ট জমা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ সহজেই সন্দেহজনক সাইটের লিংক, স্ক্রিনশট বা তথ্য পাঠাতে পারেন।

এছাড়া মোবাইল অপারেটরদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা জুয়া বা বেটিং সংক্রান্ত অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে প্রবেশ রোধ করে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ কী বলে

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইন জুয়া বা পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত কনটেন্ট প্রচার বা হোস্ট করে, তবে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

এছাড়া আইনটি বলছে, কোনো ওয়েবসাইট যদি বারবার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে একই অপরাধ করে, তবে সেটি স্থায়ীভাবে ব্লক করে দেওয়া হবে।

নৈতিক ইন্টারনেটের পথে বাংলাদেশ

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন, “আমরা চাই একটি নৈতিক, নিরাপদ ও প্রজন্মবান্ধব ইন্টারনেট পরিবেশ গড়ে তুলতে। আমাদের লক্ষ্য সংবাদমাধ্যম বা প্রযুক্তিকে সীমাবদ্ধ করা নয়, বরং অনৈতিক ব্যবহার রোধ করা।”

মন্ত্রী আরও জানান, সরকার মুক্ত ও দায়িত্বশীল সংবাদ প্রচারে বিশ্বাসী। তবে স্বাধীনতার নামে অপরাধমূলক বা সামাজিকভাবে ক্ষতিকর প্রচারণা কখনোই সহ্য করা হবে না।

জনসচেতনতার প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু সরকার নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভূমিকা রাখতে হবে।

আইসিটি বিশেষজ্ঞ ফারুক হোসেন বলেন, “অনেক সময় শিশুরা গেম খেলতে গিয়ে এমন অ্যাপ ডাউনলোড করে যা পরে জুয়ার প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায়। তাই অভিভাবকদেরও সন্তানের অনলাইন ব্যবহারে নজর রাখা জরুরি।”

বাংলাদেশ সরকার অনলাইন জুয়া, বেটিং ও পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি এর অপব্যবহারও সমাজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

এই বাস্তবতায় সরকারের কঠোর পদক্ষেপকে অনেকেই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় হিসেবে দেখছেন। তবে নীতিনির্ধারক, গণমাধ্যম, প্রযুক্তি কোম্পানি এবং নাগরিক— সবাই যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবেই গড়ে উঠবে একটি নিরাপদ, নৈতিক ও প্রজন্মবান্ধব ডিজিটাল বাংলাদেশ

MAH – 13367 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button