প্রযুক্তি

চ্যাটজিপিটি চালু করছে প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট, শিশুদের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ

Advertisement

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংস্থা ওপেনএআই চ্যাটজিপিটিতে প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট চালুর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। সংস্থার প্রধান স্যাম অল্টম্যান জানিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীরা চ্যাটবটের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো কথোপকথন করতে চাইলে তাদের জন্য নতুন সুবিধা চালু করা হবে। তবে এটি কেবলমাত্র যাচাই করা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীর জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে।

নতুন ফিচার: মানবীয় অভিজ্ঞতা ও বয়স যাচাই

গতকাল মঙ্গলবার, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে স্যাম অল্টম্যান জানান, চ্যাটজিপিটির আসন্ন সংস্করণগুলো আরও মানবীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করবে। তবে এটি কোনোভাবেই ব্যবহারকারীর জন্য বাধ্যতামূলক নয়। ডিসেম্বরে নতুন ‘এজ-গেটিং’ বা বয়স যাচাই ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে, যাচাইকৃত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীরা ইরোটিকা এবং যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়বস্তু দেখতে সক্ষম হবেন।

ওপেনএআই-এর এই পদক্ষেপের আগে, ইলন মাস্কের এআই সংস্থা এক্সএআই তাদের গ্রক চ্যাটবটে প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট চালু করেছিল। এরপরই ওপেনএআই একই ধরনের পদক্ষেপ নিল। সংস্থার আশা, এই পদক্ষেপ তাদের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হবে।

প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট বিতর্ক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। চলতি বছরের শুরুতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর আত্মহত্যা করেছিলেন। তার বাবা-মা ওপেনএআই-এর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল যে, চ্যাটজিপিটির প্যারেন্টাল কন্ট্রোল যথেষ্ট কার্যকর নয়। কিশোর অ্যাডামের সঙ্গে চ্যাটবটের কথোপকথনের লগও জমা দেওয়া হয়। সেখানে দেখা গেছে, সে আত্মহত্যার ভাবনা নিয়ে চ্যাটবটের সঙ্গে আলোচনা করেছিল।

স্যাম অল্টম্যান স্বীকার করেছেন যে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ঝুঁকির কারণে তারা আগে চ্যাটজিপিটিকে সীমিত রেখেছিলেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, নতুন টুল ব্যবহার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপদে ব্যবহারকারীর জন্য সীমাবদ্ধতা শিথিল করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের মন্তব্য

ওপেনএআই-এর নতুন সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আইন সংস্থা বোয়েস শিলার ফ্লেক্সনারের অংশীদার জেনি কিম প্রশ্ন তুলেছেন, “কিভাবে নিশ্চিত করা হবে যে শিশু বা কিশোররা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত কনটেন্টে প্রবেশ করতে পারবে না?” কিম আরও উল্লেখ করেন, “বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো মানুষকে কখনো কখনো পরীক্ষা বা গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের গভর্নর গ্যাভিন নিউসম সম্প্রতি একটি বিলে ভেটো দিয়েছেন। এই বিল শিশুদের ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। নিউসম বলেন, শিশু ও কিশোরদের জন্য নিরাপদ এআই ব্যবহার শেখানো অপরিহার্য, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কনটেন্ট সীমাবদ্ধতা ছাড়াই চালু করার প্রভাবও সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত।

ফেডারেল পর্যবেক্ষণ

মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন (FTC) ইতোমধ্যে চ্যাটবটের শিশুদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া কেমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ওপেনএআই-এর এই পদক্ষেপ বাজারে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার প্রচেষ্টা মাত্র। যদিও সংস্থার আয় বাড়ছে, এখনও এটি লাভজনক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দ্রুত বাজার দখলের জন্য সংস্থাটি এমন বিতর্কিত পদক্ষেপ নিতে পারে।

শিশুদের নিরাপত্তা ও প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টের চ্যালেঞ্জ

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চ্যাটবটগুলোতে প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট চালু করার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  1. বয়স যাচাই: সঠিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীদের আলাদা করা।
  2. মানসিক স্বাস্থ্য: ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন প্রদান।
  3. শিশু সুরক্ষা: ছোটরা যেন প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টে প্রবেশ করতে না পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করলে, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।

অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এআই চ্যাটবটের প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

  • ইউরোপ: জার্মানি ও ফ্রান্সে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর নিয়ম চালু রয়েছে।
  • এশিয়া: সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট কনটেন্ট ফিল্টার বাধ্যতামূলক।
  • আমেরিকা: যুক্তরাষ্ট্রে সংস্থাগুলো স্বেচ্ছামূলক নিয়ম ও সরকারের নজরদারির মধ্যে কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওপেনএআই-র এই নতুন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর প্রভাব শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক আচরণের উপর পড়তে পারে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ওপেনএআই ঘোষণা করেছে, ডিসেম্বর মাসে পুরোপুরি চালু হওয়ার পর, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীরা প্রয়োজনীয় বৈধ যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নতুন কনটেন্ট অ্যাক্সেস করতে পারবে। সংস্থা আরও বলেছে, তারা নতুন প্যারেন্টাল কন্ট্রোল এবং নিরাপত্তা টুল নিয়ে কাজ করছে, যাতে শিশুদের কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্টে প্রবেশ রোধ করা যায়।

অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, “আমরা চাই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীরা আরও মানবিক এবং বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা পান। তবে, এটি শিশুদের নিরাপত্তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।”

সংবাদ বিশ্লেষক ও বাজার প্রতিক্রিয়া

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওপেনএআই-র এই পদক্ষেপ সংস্থার সাবস্ক্রিপশন বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতে পারে। তবে শিশুদের নিরাপত্তা, আইনি ঝুঁকি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

বাজারে এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক দিক থেকে দেখা হলেও, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, সামাজিক দায়িত্ব এবং প্রযুক্তির সীমা বজায় রাখা অপরিহার্য।

চ্যাটজিপিটি এখন প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট চালুর পথে, যা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা আনবে। তবে শিশুদের নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আইনি দায়িত্ব বিষয়গুলো এখনও বড় প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, সরকারের নজরদারি, এবং প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে।

এদিকে, ওপেনএআই-এর এই পদক্ষেপ প্রযুক্তি, ব্যবসা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার সংমিশ্রণ। এটি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত উন্নতি নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

MAH – 13334 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button