চার্জারের বিদায়, এক ডায়মন্ড ব্যাটারি চলবে টানা ৫,৭০০ বছর

ভাবুন তো, আপনার ফোন, ল্যাপটপ বা যেকোনো যন্ত্র একবার ব্যাটারি বসানোর পর আর কখনো চার্জ দিতে হলো না। শুনতে যেন সাই-ফাই গল্পের মতো! কিন্তু বাস্তবে এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে এগোচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ডায়মন্ড ব্যাটারি নামের এই বিশেষ ব্যাটারি একটানা ৫,৭০০ বছর পর্যন্ত শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম।
কী এই ডায়মন্ড ব্যাটারি?
ডায়মন্ড ব্যাটারি মূলত এক ধরনের পারমাণবিক ব্যাটারি, যেখানে কার্বন-১৪ নামের তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই পদার্থ সাধারণত নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের গ্রাফাইট ব্লকে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা এই কার্বন-১৪-কে কৃত্রিম হীরার ভেতরে বন্দি করে দেন। হীরা এখানে দুইভাবে কাজ করে—একদিকে রেডিয়েশন শিল্ড হিসেবে, অন্যদিকে রেডিয়েশনকে বিদ্যুতে রূপান্তরকারী উপাদান হিসেবে।
এর ফলে তৈরি হয় এমন একটি শক্তির উৎস, যা স্থিতিশীল, নিরাপদ এবং প্রায় চিরকাল চলতে পারে। কার্বন-১৪-এর অর্ধেক জীবন ৫,৭৩০ বছর, ফলে দীর্ঘমেয়াদে শক্তি উৎপাদন সম্ভব হয়।
কারা এই প্রকল্পে কাজ করছে?
এই বিপ্লবী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টার্টআপ এনডিবি ইনকর্পোরেটেড, ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সহযোগিতায়। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে পারমাণবিক বর্জ্যকে ব্যবহার করে এমন এক শক্তির সমাধান তৈরি করা, যা পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
কেন এত বড় উদ্ভাবন?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাটারির ভূমিকা অপরিসীম। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি, চিকিৎসা সরঞ্জাম—সবকিছুই ব্যাটারির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান ব্যাটারির সীমাবদ্ধতা হলো এর চার্জ দ্রুত শেষ হয়ে যায়, আর বারবার চার্জ দিতে হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর ব্যাটারি বদলাতে হয়।
ডায়মন্ড ব্যাটারি এ সমস্যার সমাধান দেবে। একবার বসানোর পর শত শত বছর চলতে পারবে, এমনকি কোনো ডিভাইসকে সারাজীবনের জন্য কার্যকর রাখতে সক্ষম হবে।
মহাকাশ গবেষণায় সম্ভাবনা
এই ব্যাটারির সবচেয়ে বড় ব্যবহার হতে পারে মহাকাশ অনুসন্ধানে। এখনকার মহাকাশযান সাধারণত প্লুটোনিয়াম-২৩৮-এর ওপর নির্ভরশীল, যা পাওয়া খুবই কঠিন এবং ব্যয়বহুল। অন্যদিকে, সোলার প্যানেল দূর মহাকাশে সবসময় কার্যকর হয় না।
ডায়মন্ড ব্যাটারি ব্যবহার করলে একটি মহাকাশযান শত শত বছর চলতে পারবে, বিদ্যুতের ঘাটতি ছাড়াই। ফলে দূরবর্তী গ্রহ বা সৌরজগতের বাইরে দীর্ঘ অভিযান সম্ভব হবে। নাসাও ইতিমধ্যেই এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োগ
চিকিৎসায় ডায়মন্ড ব্যাটারির ব্যবহার হতে পারে যুগান্তকারী। যেমন পেসমেকার। সাধারণত কয়েক বছর পরপর এর ব্যাটারি বদলাতে হয়, যা সার্জারির মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু ডায়মন্ড ব্যাটারি ব্যবহার করলে একজন রোগীর সারা জীবনের জন্য একবারেই সমাধান হয়ে যাবে।
এছাড়া হাসপাতালের জেনারেটর, দূরবর্তী এলাকায় চিকিৎসা সরঞ্জাম চালানো—সবক্ষেত্রেই এটি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।
পৃথিবীতে ব্যবহারিক দিক
ডায়মন্ড ব্যাটারি শুধু মহাকাশ বা চিকিৎসায় নয়, দৈনন্দিন জীবনেও ব্যবহার হতে পারে। ভবিষ্যতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা অন্যান্য গ্যাজেটে এটি ব্যবহার করা সম্ভব। কল্পনা করুন, একটি ফোন কিনলেন আর চার্জার নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই!
এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়, সেখানেও এ ধরনের ব্যাটারি টেকসই সমাধান দিতে পারে।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
তেজস্ক্রিয় উপাদান ব্যবহারের কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা নিয়ে। সাধারণ মানুষ হয়তো চাইবে না ‘পারমাণবিক ব্যাটারি’ নিজের পকেটে রাখতে। তবে বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত করেছেন, এই ব্যাটারির রেডিয়েশন মানুষের দেহ থেকে নির্গত স্বাভাবিক রেডিয়েশনের চেয়েও কম। হীরা এখানে সম্পূর্ণ শিল্ড হিসেবে কাজ করায় আশঙ্কার কিছু নেই।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
তবে প্রযুক্তির সামনে এখনো কিছু বড় বাধা আছে। প্রথমত, কৃত্রিম হীরা তৈরি এখনো ব্যয়বহুল। দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবহারে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপিত থাকে। তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনও বড় চ্যালেঞ্জ।
গবেষকরা বলছেন, অন্তত এক দশক সময় লাগবে এই ব্যাটারিকে সাধারণ ব্যবহারের উপযোগী করতে। তবে যদি সফলভাবে তা করা যায়, তবে এটি হবে ২১শ শতাব্দীর অন্যতম বড় প্রযুক্তিগত বিপ্লব।
ডায়মন্ড ব্যাটারি শুধু একটি ব্যাটারি নয়, এটি হতে পারে শক্তি জগতের এক স্থায়ী সমাধান। পারমাণবিক বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে হাজার বছরের শক্তি উৎপাদন করার ক্ষমতা এর আছে। যদিও এখনো এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তবে যদি বাস্তবে প্রয়োগ সম্ভব হয়, তবে চার্জারের যুগ সত্যিই একদিন বিদায় নেবে।
এম আর এম – ১৩৬৫,Signalbd.com