ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ দাবানল। ৮০ বছরে এমন আগুন আর দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত পুড়ে গেছে বিশাল অঞ্চল, ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষ ও ঘরবাড়ি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হাজারো দমকল কর্মী।
ফ্রান্সে শুরু হয়েছে ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী দাবানল। প্যারিসের চেয়েও বড় এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন দুই হাজারের বেশি দমকলকর্মী। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই দাবানলকে ‘নজিরবিহীন’ বলছে।
বিস্তারিত
দাবানল শুরু হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের অড অঞ্চলে। গত কয়েক দিনে এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ১৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকায়। এই আগুনে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত একজন। দমকল বাহিনীর ২০০০-এর বেশি সদস্য আগুন নেভাতে কাজ করছেন, তবে বাতাসের গতি বেশি থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত আড়াই হাজার ঘরবাড়ি। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আগুনের কারণে রাস্তাঘাটে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রেতাইয়ো জানিয়েছেন, ১৯৪৯ সালের পর এত বড় দাবানল আর দেখা যায়নি।
কেন এমন দুর্যোগ?
গত কয়েক বছর ধরে ফ্রান্সসহ ইউরোপজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা এবং উচ্চ তাপমাত্রা এই ধরনের দাবানলের অন্যতম কারণ। এবছরের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, যা দাবানলের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ফ্রান্সে ২০২২ ও ২০২৩ সালেও দাবানল দেখা গেছে, কিন্তু এবারের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগুনের গতিবিধি এবং বিস্তারের মাত্রা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি জলবায়ু সংকটেরই ফলাফল।
ক্ষয়ক্ষতি ও প্রভাব
এই দাবানলে যে পরিমাণ বনাঞ্চল ও বসতবাড়ি পুড়ে গেছে, তা অতীতের যেকোনো একক দাবানলের চেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার হেক্টর এলাকা ছাই হয়ে গেছে। অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।
অড অঞ্চলের অনেক ছোট শহর ও গ্রাম পুরোপুরি খালি করে ফেলতে হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফসল ও পশুপালন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দিতে হয়েছে, যার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরু দাবানল কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি একে “নজিরবিহীন দুর্যোগ” বলে অভিহিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে সরকার এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করতে বলেছেন জনগণকে।
সরকার জরুরি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। সেনাবাহিনী, দমকল বাহিনী ও উদ্ধারকারী দল মাঠে নেমেছে। ভয়াবহ এলাকাগুলো থেকে জনগণকে সরিয়ে আনা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও তুলনা
শুধু ফ্রান্স নয়, দাবানলে পুড়ছে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ। স্পেনের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। গ্যালিসিয়ার পন্তেসেছো শহরে ১৭০ হেক্টরের বেশি এলাকা পুড়ে গেছে। সেখানে শত শত দমকলকর্মী আবাসিক এলাকা রক্ষায় কাজ করছেন।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতেও দাবানল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সান্তা বারবারা ও সান লুইস অবিসপো কাউন্টিতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। মোট ৮৩ হাজার একরের বেশি এলাকা দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দাবানল মোকাবিলায় বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্য নিচ্ছে দমকল বাহিনী।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিই এই ধরনের দাবানলের পেছনে মূল কারণ। আগুন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট মনিটরিং এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি।
এছাড়া, বন ব্যবস্থাপনা ও ভূমি পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে প্রশিক্ষিত করে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করাও জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেষ কথা
ফ্রান্সে দাবানলের এই ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে আবারও জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ আরও ঘন ঘন দেখা যেতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো — জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা কি প্রস্তুত এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার?
এম আর এম – ০৭৪১, Signalbd.com



