মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে আরও এক কিশোরীর মৃত্যু। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়া তাসনিম বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যাওয়ার পর ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা এখন ৩১। পরিবারের কান্না, স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ—সব মিলিয়ে ক্রমেই বাড়ছে জনমনে ক্ষোভ ও উদ্বেগ।
মর্মান্তিক মৃত্যু মিছিল থামছে না। মাহতাবের পর এবার না-ফেরার দেশে পাড়ি জমালো মাহিয়াও। রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হয়ে মারা গেছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়া তাসনিম (১৫)। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় সে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে মৃত্যু হয় মাহিয়া তাসনিমের। চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ ছিল, যার মধ্যে মুখ, হাত ও বুকের অংশ মারাত্মকভাবে পোড়েছিল।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, “মাহিয়া অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় ছিল। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাকে আর বাঁচানো গেল না।”
এ নিয়ে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে, যার মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
মাহিয়ার পরিবার কী বলছে?
নিহত মাহিয়ার মা আফরোজা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জানান, “পাঁচ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছি। আমার তিন মেয়ের মধ্যে মাহিয়া ছিল মেজো। আজ তাকেও হারালাম। সকাল ৭টায় মেয়েটা বাসা থেকে বের হয়েছিল স্কুলে যাওয়ার জন্য। আমি তো জানতাম না, ও আর ফিরবে না।”
তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ কোচিং করানোর নামে একটায় ক্লাস শেষ হওয়ার পরও বাচ্চাদের আটকে রাখে। যদি ক্লাস শেষ হতেই তারা বের হতে পারতো, তাহলে অনেকেই হয়তো বেঁচে যেত। ক্লাসরুমকে খাঁচার মতো করে বানানো হয়েছে—বাচ্চারা চাইলে বের হতে পারে না। এই দায় কে নেবে এখন?”
মাহতাব ও মাহিয়ার একদিনেই মৃত্যু
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে মারা যান সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহতাব রহমান। তার শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল, শ্বাসনালিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর একই দিন বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন মাহিয়া তাসনিম।
দুজনই ছিল মাইলস্টোন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী। একদিনের ব্যবধানে দুই পরিবারে নেমে এসেছে অপূরণীয় শোক। এ মৃত্যু মিছিলে শোকাহত হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মহল।
কীভাবে ঘটলো ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি?
উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় কয়েকদিন আগে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনাবশত বিধ্বস্ত হয়। সেই মুহূর্তে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ছুটির পর শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছিলো। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
সেই আগুনে দগ্ধ হন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পথচারীরা। ৪০ জনের বেশি মানুষ গুরুতর দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ধীরে ধীরে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
জনমনে ক্ষোভ ও প্রশ্ন: নিরাপত্তা কোথায়?
এই দুর্ঘটনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ বলছেন, “স্কুলের পাশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম কেন?”
মাহিয়ার মা জানান, “আমার মেয়ে বাঁচতে পারতো, যদি স্কুলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতো, যদি সময়মতো ছুটি দিতো, আর যদি বাইরে বিমান অনুশীলনের ঝুঁকি না থাকতো।”
সরকারি অবস্থান ও তদন্তের অগ্রগতি
দুর্ঘটনার তদন্তে সরকার ইতোমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, “এই দুর্ঘটনার উৎস, দোষীদের গাফিলতি এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে করণীয় নির্ধারণে আমরা কাজ করছি।”
প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, শিক্ষামন্ত্রী—সবাই গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার দাবি
এই ঘটনার পর অভিভাবকরা ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জরুরি বের হওয়ার পথ, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা—সবকিছুর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, “শুধু তদন্তই যথেষ্ট নয়, দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা পরিকল্পনা দরকার। বিমানবাহিনী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”
শেষকথা
মাহতাবের পর মাহিয়ার চলে যাওয়া শুধুই সংখ্যা বাড়ানো নয়—এটি জাতির হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষতের নাম। এই ট্র্যাজেডি আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে, শিশুদের নিরাপত্তা কোনো গৌণ বিষয় নয়। এখন প্রশ্ন হলো, এমন মৃত্যু আরও কতো হলে আমরা জাগবো?
এম আর এম – ০৪৯৯ , Signalbd.com



