প্রযুক্তি

চীনের হাইপারসনিক ‘ফেইটিয়ান-২’: ঘণ্টায় ১৫,০০০ কিমি গতি

চীন আবারো বিশ্বের সামরিক ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নজর কেড়েছে নতুন একটি হাইপারসনিক বিমানের পরীক্ষামূলক সফল উড়ানের মাধ্যমে। নাম ‘ফেইটিয়ান-২’। এই বিমানের সর্বোচ্চ গতি মাক ১২, অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ১৪,৮০০ কিলোমিটার, যা শব্দের গতির চেয়ে ১২ গুণ বেশি এবং প্রচলিত হাইপারসনিক বিমানের গতি সীমা মাক ৫-এর দ্বিগুণেরও বেশী।

এই প্রযুক্তিগত অর্জন চীনের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার নতুন একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধকালীন ও বাণিজ্যিক উড়ানে বিপ্লব ঘটতে পারে।

হাইপারসনিক প্রযুক্তি: পৃথিবীর দ্রুততম যানবাহন

হাইপারসনিক প্রযুক্তির অর্থ হলো এমন যানবাহন যা শব্দের গতির ৫ গুণ বা তার বেশি গতিতে (মাক ৫ বা তার ওপরে) চলতে সক্ষম। শব্দের গতি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১,২৩৫ কিলোমিটার। তাই মাক ৫ হলে গতি দাঁড়ায় প্রায় ৬,১৭৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। কিন্তু ‘ফেইটিয়ান-২’ মাক ১২-এ পৌঁছে গিয়েছে, যা ঘণ্টায় ১৪,৮০০ কিলোমিটার, এই দিক থেকে এটি পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম বিমান।

ফেইটিয়ান-২-এর বিশেষ প্রযুক্তি: রকেট ও র‍্যামজেট ইঞ্জিনের যুগলবন্দী

ফেইটিয়ান-২-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে রকেট এবং র‍্যামজেট ইঞ্জিন একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

  • রকেট ইঞ্জিন: জ্বালানি ও অক্সিডাইজার (অক্সিজেন সরবরাহকারী উপাদান) একসঙ্গে বহন করে। যখন জ্বালানি জ্বলে, প্রচণ্ড গরম গ্যাস তৈরি হয়, যা থ্রাস্ট (উত্প্রেরক শক্তি) হিসেবে বিমানের পিছন থেকে নির্গত হয়।
  • র‍্যামজেট ইঞ্জিন: এতে শুধুমাত্র জ্বালানি থাকে, এবং বাইরের বাতাসকে সংকুচিত করে অক্সিডাইজারের মতো ব্যবহার করে জ্বালানি পোড়ানো হয়। এটি বাতাসের ওপর নির্ভরশীল এবং উচ্চগতিতে কাজ করে।

এই দুই ধরনের ইঞ্জিনকে একসঙ্গে ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক প্রপালশন সিস্টেম থেকে অন্যটিতে রূপান্তর করা অত্যন্ত জটিল ও নতুন প্রযুক্তি। ‘ফেইটিয়ান-২’ সফলভাবে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেছে যা বিশ্বে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য

এই দুই ইঞ্জিনের সমন্বয় ও চলন্ত অবস্থায় রূপান্তর প্রযুক্তিগতভাবে চরম কঠিন। বিমানের গতি ও তাপমাত্রা খুব বেশি থাকায় প্রচণ্ড তাপ এবং চাপ সইয়ে কাজ করতে হয়।

চীনা গবেষকরা জানিয়েছেন, ফেইটিয়ান-২ উড়ন্ত অবস্থায় রকেট থেকে র‍্যামজেট প্রপালশনে নির্বিঘ্নে পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং তাপ ও চাপ সহ্য করেছে।

চীনা গণমাধ্যমে ‘ফেইটিয়ান-২’র লঞ্চপ্যাড থেকে একাধিক ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যা এই প্রকল্পের বাস্তবতার প্রমাণ দেয়।

সামরিক দিক থেকে গুরুত্ব

হাইপারসনিক অস্ত্র ও যানবাহনের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইপারসনিক অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ,

  • এগুলো দীর্ঘ পাল্লার রাডারের সীমার বাইরে থাকে, অর্থাৎ রাডার দ্বারা শনাক্ত করা কঠিন হয়।
  • উচ্চতা কম হওয়ায় শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই অস্ত্রকে পর্যবেক্ষণ বা প্রতিরোধ করতে পারে না।
  • অস্ত্রটি তার গতির কারণে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতারণা করতে পারে।

এই কারণে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিরা নিজেদের নিজস্ব হাইপারসনিক প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ও চীনের অগ্রগতি

চীনের এই প্রযুক্তিগত সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। ২০২০-এর পরে যুক্তরাষ্ট্র নানা চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, বিশেষ করে যেগুলো হাইপারসনিক প্রযুক্তি ও উন্নত কম্পিউটিংয়ে কাজ করে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ২৭টি চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা মার্কিন এআই ও অ্যাডভান্সড কম্পিউটিং সরবরাহকারীদের সঙ্গে ব্যবসা করতে বাধা দেয়। এর লক্ষ্য ছিল চীনের সামরিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ধীর করা।

তবে ‘ফেইটিয়ান-২’র সফল পরীক্ষামূলক উড়ান চীনের উচ্চ প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ভবিষ্যতে হাইপারসনিক প্রযুক্তির সম্ভাবনা

ফেইটিয়ান-২-এর মতো বিমান শুধুমাত্র সামরিক ক্ষেত্রে নয়, বাণিজ্যিক বিমান চলাচলেও বিপ্লব আনতে পারে। যদি নিরাপদ ও কার্যকরভাবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে এই গতি দিয়ে এক দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী দশকে হাইপারসনিক প্রযুক্তির উন্নয়ন বিশ্ব বায়ু যাত্রাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে পারে।

সারমর্ম

  • চীনের ‘ফেইটিয়ান-২’ হাইপারসনিক বিমান মাক ১২-এ (প্রায় ঘণ্টায় ১৪,৮০০ কিলোমিটার) সফল পরীক্ষামূলক উড়ান সম্পন্ন করেছে।
  • এটি রকেট ও র‍্যামজেট ইঞ্জিন যুগলবন্দী প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা বিশ্বে নতুন।
  • এই প্রযুক্তি সামরিক ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ হাইপারসনিক অস্ত্র সহজে শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায় না।
  • যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিশ্বশক্তিরা এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতায় রয়েছে।
  • ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি বাণিজ্যিক বিমান চলাচনেও বিপ্লব আনতে পারে।
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button