প্রযুক্তি

নামকরা ‘হাজ কাসেম’: ইরানের নতুন ম্যানুভারেবল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও তার ভয়াবহতা

ইরান সম্প্রতি তাদের নতুন অত্যাধুনিক ম্যানুভারেবল ব্যালিস্টিক মিসাইল ‘হাজ কাসেম’ উন্মোচন করেছে, যার নামকরণ করা হয়েছে ইরানের বিখ্যাত কুদস বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানির নামে। এই মিসাইলটি ইরানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে এবং এটি ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

‘হাজ কাসেম’ মিসাইলের প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ ৪ মে বলেন, ‘হাজ কাসেম’ মিসাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক টার্মিনাল হাই-অল্টিচিউড এরিয়া ডিফেন্স (THAAD) এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম। এই মিসাইলের গতি ঘণ্টায় ১,২০০ কিলোমিটার, যা অত্যন্ত দ্রুতগতির এবং মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে।

তাছাড়া, তাসনিম বার্তা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘হাজ কাসেম’ ক্ষেপণাস্ত্রটির বিশেষ উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম রয়েছে, যা লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত হামলা নিশ্চিত করে। এতে রয়েছে এমন একটি ওয়ারহেড যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রতিরোধের প্রযুক্তিও যুক্ত রয়েছে।

কাসেম সোলেইমানির স্মরণে

এই ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে কাসেম সোলেইমানির নামে, যিনি ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলিউশনারি গার্ডের কুদস বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি, মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরাকের বাগদাদে নিহত হন তিনি। সোলেইমানি ইরানের সামরিক কৌশল এবং প্রভাব বিস্তারে অন্যতম মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যু ইরান-আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পটভূমি

গত ১২ জুন ইরানে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়, যা ইরানের ৭৪ জন নাগরিকের প্রাণহানি ঘটায়। এই ঘটনার পর ইরান প্রতিহিংসামূলক হিসেবে ‘হাজ কাসেম’ মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একাধিক হামলা চালিয়েছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত ৮ জন ইসরায়েলি মারা গেছে।

এই সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘হাজ কাসেম’ মিসাইলের ব্যবহার ইরানের সামরিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে এবং এটি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠেকানো আরও কঠিন করে তুলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব

ইরানের এই নতুন মিসাইল চালানোর পেছনে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার শত্রুতা বহু বছর ধরেই চলছে, যার মধ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি বড় হামলা ও পাল্টা হামলা অন্তর্ভুক্ত। ‘হাজ কাসেম’ মিসাইলের কার্যকর ব্যবহার ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের এই শক্তিশালী মিসাইল প্রযুক্তি সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নতুন দিকনির্দেশনা দেবে। তবে একই সাথে, এটি অঞ্চলটির উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে এবং বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে।

মিসাইল প্রযুক্তির গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ

‘হাজ কাসেম’ ম্যানুভারেবল ব্যালিস্টিক মিসাইল এমন একটি প্রযুক্তিগত সাফল্য যা বিশ্বে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। এটি সহজেই ঘুরে ফিরতে সক্ষম, যা লক্ষ্যবস্তু এড়ানো বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এর ফলে, সামরিক টেকনোলজি এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য করবে বিশ্ব শক্তিগুলোকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের উন্নত মিসাইল প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে, যা বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তাই এই প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নতুন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

ইরানের ‘হাজ কাসেম’ মিসাইল কেবল একটি অস্ত্র নয়, এটি ইরানের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার প্রতীক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অবস্থার এক নতুন মোড়। এর ব্যবহার যুদ্ধের গতিধারাকে বদলে দিতে পারে এবং নিরাপত্তার নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। এই মিসাইলের আত্মপ্রকাশ শুধু ইরানের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বকেই একটি সতর্কবার্তা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button