প্রযুক্তি

মানবদেহে প্রথমবারের মতো সফল মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন

যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান নিউরোটেক স্টার্টআপ প্যারাড্রমিকস সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম সফল মানব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন বা ব্রেন ইমপ্ল্যান্ট সম্পন্ন করেছে। নিউরালিংকের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা এই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটি ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) প্রযুক্তিতে এটি একটি বৈপ্লবিক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করছে বিশেষজ্ঞরা।

কনেক্সাস: মস্তিষ্কে ১০ মিনিটে প্রতিস্থাপিত অত্যাধুনিক ডিভাইস

এই যুগান্তকারী সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘কনেক্সাস’ নামের একটি সুপার-অ্যাডভান্সড বিসিআই ডিভাইস, যা মানুষের মস্তিষ্কে মাত্র ১০ মিনিটের অস্ত্রোপচারে স্থাপন ও অপসারণ করা সম্ভব।
নিউরোসার্জন ডা. ম্যাথু উইলসি এবং ডা. ওরেন সাঘের নেতৃত্বে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ মে প্রথম এই অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

প্রাথমিকভাবে ডিভাইসটি মৃগী আক্রান্ত এক রোগীর মস্তিষ্কে সাময়িকভাবে স্থাপন করা হয়, যার মাধ্যমে গবেষকেরা খিঁচুনির উৎপত্তিস্থল শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। এটি শুধুমাত্র একটি পরীক্ষামূলক প্রতিস্থাপন হলেও, গবেষণা জগতে এটি ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে।

কীভাবে কাজ করে কনেক্সাস?

কনেক্সাস হলো এমন একধরনের অত্যাধুনিক মাইক্রোইলেকট্রোডভিত্তিক BCI যেটি মস্তিষ্কের নিউরোনের সংকেত পড়ে তা ভাষা, লেখা বা কম্পিউটার কার্সর নিয়ন্ত্রণে রূপান্তর করতে পারে।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাকশক্তিহীন স্ট্রোক, মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত বা ALS আক্রান্ত রোগীদের আবার কথা বলার ও যোগাযোগের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনেক্সাসের বিশেষত্ব হচ্ছে এর দ্রুত স্থাপনযোগ্যতা, স্বল্প আঘাত এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা।

নিউরালিংক বনাম প্যারাড্রমিকস: প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার শীর্ষে

প্যারাড্রমিকসের এই সাফল্য সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি করছে এলন মাস্কের আলোচিত প্রতিষ্ঠান নিউরালিংক-কে।
যেখানে নিউরালিংক ইতোমধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন করেছে এবং BCI নিয়ে একাধিক পরীক্ষা চালাচ্ছে, সেখানে প্যারাড্রমিকস প্রথমবারের মতো সফলভাবে মস্তিষ্কে স্থাপনের পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্যারাড্রমিকসের প্রধান নির্বাহী ম্যাট অ্যাঙ্গেল বলেন, “বর্তমানে যেসব জটিল নিউরোলজিক্যাল রোগকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হয়, ভবিষ্যতে প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান সম্ভব হবে—এই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।”

প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক বছর ভেড়ার ওপর বিসিআই প্রযুক্তির পরীক্ষা চালিয়ে মানবদেহে সফল প্রতিস্থাপন নিশ্চিত করেছে। এখন তারা পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদি নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা (FDA)-র অনুমোদন মেলে, তবে ২০২৫ সালের মধ্যেই বড় আকারে মানব ট্রায়াল শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্যারাড্রমিকসের দাবি অনুযায়ী, এই ডিভাইসটি একবার বাজারজাত হলে এর সম্ভাব্য মূল্য হতে পারে প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলার

বিসিআই প্রযুক্তির পেছনের ইতিহাস

ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জ্যাক ভিদাল ১৯৭৩ সালে।
এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে গবেষকরা এই প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন।

২০০৩ সালে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যায়, একটি বানর মাইক্রোইলেকট্রোড যুক্ত রোবটিক হাত সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
২০০৪ সালে পঙ্গু অ্যাথলেট ম্যাট ন্যাগল বিসিআই ব্যবহার করে কম্পিউটার কার্সর ও কৃত্রিম হাত চালাতে সক্ষম হন। এইসব গবেষণা বিসিআই প্রযুক্তিকে বাস্তবের মাটিতে আনার পথ প্রশস্ত করেছে।

বিসিআই প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও মানব সভ্যতায় প্রভাব

BCI প্রযুক্তির সাহায্যে মস্তিষ্ক ও যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে ডাইরেক্ট ইন্টারফেস তৈরি করা সম্ভব, যা ভবিষ্যতের চিকিৎসা ও যোগাযোগ পদ্ধতির অভাবনীয় পরিবর্তন আনতে পারে।
বিশেষত স্ট্রোক, পক্ষাঘাতগ্রস্ততা, পারকিনসন, ALS, স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি রোগের চিকিৎসায় এটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

এছাড়া, ভবিষ্যতে AI এবং মস্তিষ্কের সম্মিলিত কাজের সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরছেন বিজ্ঞানীরা। উদাহরণস্বরূপ, BCI-এর মাধ্যমে চিন্তা দিয়েই মেশিন নিয়ন্ত্রণ, কথা বলা, এমনকি স্মৃতি সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও অনেকটা বাস্তবের কাছাকাছি চলে এসেছে।

প্যারাড্রমিকসের এই সাফল্য শুধু একটি কোম্পানির বিজয় নয়, বরং এটি মানবসভ্যতার স্নায়ুবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ
মস্তিষ্কের সংকেত বোঝা ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি এখন কল্পবিজ্ঞানের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব চিকিৎসার হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

যদি এই গবেষণা ও প্রযুক্তি পরিকল্পনা সফলভাবে বাজারে আসে, তবে আগামী দশকের মধ্যেই মানব সভ্যতায় একটি নীরব বিপ্লব ঘটে যেতে পারে—যেখানে মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে হয়ে উঠবে আরও বেশি সক্ষম, সংযুক্ত এবং আত্মনির্ভর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button