বিশ্ব

পুতিন ও আমি একসঙ্গে না বসা পর্যন্ত কিছুই হবে না: ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি বৈঠক ছাড়া ইউক্রেন শান্তি আলোচনায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব নয়। বৃহস্পতিবার কাতার থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) যাওয়ার পথে তিনি এই মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ পরিদর্শন করেন, যেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবুধাবির যুবরাজ শেখ খালেদ বিন মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।

ট্রাম্পের এই বক্তব্য ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সমাধানে তাঁর ব্যক্তিগত কূটনৈতিক পদ্ধতির উপর জোর দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। তিনি জানান, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সরাসরি আলোচনাই এই সংকটের সমাধানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এই বৈঠকের সম্ভাব্য সময় বা স্থান সম্পর্কে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেননি।

তুরস্কে আলোচনা: প্রতিনিধিদলের উপস্থিতি

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী উড়োজাহাজ এয়ার ফোর্স ওয়ানে ইউএই যাওয়ার পথে বিবিসির একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, রাশিয়া তুরস্কে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে, তা নিয়ে তিনি কি হতাশ? জবাবে ট্রাম্প বলেন, “দেখুন, পুতিন ও আমি একসঙ্গে না বসা পর্যন্ত কিছুই হবে না, ঠিক আছে?” তিনি আরও উল্লেখ করেন, পুতিন তুরস্কে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কারণ তিনি ধারণা করেছিলেন ট্রাম্পও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। ট্রাম্প বলেন, “আমি না গেলে তিনি যাচ্ছিলেন না। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন, আমি মনে করি, তিনি ও আমি একসঙ্গে না বসা পর্যন্ত কিছুই ঘটছে না। তবে আমাদের এটা সমাধান করতেই হবে। কারণ, অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।”

তুরস্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রতিনিধিদল ইস্তাম্বুলে পৌঁছেছে। রাশিয়া ও তুরস্কের প্রতিনিধিদলের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই আলোচনা ইউক্রেন সংকটের সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে ট্রাম্পের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিনি এই প্রতিনিধিদল-ভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে সরাসরি নেতৃস্থানীয় বৈঠকের উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত: পটভূমি

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। এরপর থেকে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই যুদ্ধ চলছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল কয়েক দফা সরাসরি বৈঠক করে। তুরস্কে এই ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তবে একপর্যায়ে এই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমানে তুরস্ক আবারও এই সংঘাতের সমাধানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বৃহস্পতিবার আনাতলিয়া শহরে ন্যাটোর একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে বলেন, “পক্ষগুলোর অবস্থানে যদি সামঞ্জস্য তৈরি করা যায় এবং বিশ্বাস স্থাপন করা যায়, তাহলে তা শান্তির পথে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে।” তিনি আরও জানান, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বর্তমানে আঙ্কারায় রয়েছেন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

জেলেনস্কির মন্তব্য ও তুরস্কের ভূমিকা

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বৃহস্পতিবার আঙ্কারার এসেনবোগা বিমানবন্দরে পৌঁছে রানওয়েতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের উপস্থিতি নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, “আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্বের স্তর সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে যেটুকু শুনেছি, তাতে তাদের লোকদেখানো বলে মনে হচ্ছে।” তিনি জানান, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং আলোচনার বিষয়ে সমন্বয় করছে।

জেলেনস্কির এই মন্তব্য রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের প্রতি তাঁর সন্দেহ এবং শান্তি আলোচনায় অগ্রগতির জন্য আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়। তবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিদান আশাবাদী। তিনি বলেন, “এই সফরগুলোই প্রমাণ করে, অবশেষে শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে।” তিনি আরও মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে পক্ষগুলোর মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব।

পুতিন ও জেলেনস্কির অবস্থান

চলতি সপ্তাহের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেনের নেতার সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করতে প্রস্তুত। প্রাথমিকভাবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও জেলেনস্কি পরে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে সম্মতি দেন। তবে উভয় নেতার মধ্যে এই বৈঠক কবে বা কোথায় হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

ট্রাম্পের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি এই সংঘাতে একটি মধ্যস্থতাকারী বা প্রধান আলোচক হিসেবে নিজেকে দেখতে চান। তাঁর এই অবস্থান ইউক্রেন সংকটের সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, তবে এটি একই সঙ্গে অন্যান্য পক্ষের, বিশেষ করে ইউক্রেন ও তুরস্কের, প্রচেষ্টার সঙ্গে কীভাবে সমন্বিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি সংকট, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শান্তি আলোচনার প্রতিটি পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

তুরস্কের মধ্যস্থতার ভূমিকা এই সংকটে একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম প্রদান করছে। তবে ট্রাম্পের মন্তব্য এবং জেলেনস্কির সন্দেহপূর্ণ অবস্থান থেকে বোঝা যায়, শান্তি প্রক্রিয়া এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য ট্রাম্পের জোর দেওয়া এবং জেলেনস্কির সতর্ক অবস্থান এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

উপসংহার

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সমাধানে শান্তি আলোচনা একটি জটিল এবং সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য এই প্রক্রিয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত নেতৃত্বের উপর জোর দিলেও, তুরস্কের মধ্যস্থতা এবং ইউক্রেনের অবস্থান এই আলোচনার গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতির দিকে নজর রাখছে, যাতে এই সংঘাতের মাধ্যমে সৃষ্ট মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button