মুম্বাইয়ের বিমানবন্দরে যাত্রীর ব্যাগে ৪৭টি বিষাক্ত সাপ

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, থাইল্যান্ড থেকে আসা এক যাত্রীর লাগেজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৭টি বিষাক্ত সাপ এবং পাঁচটি দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপ। এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ভারতীয় যাত্রীকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারীরা।
৪৭টি সাপ, যার অধিকাংশই বিষধর ভাইপার
রোববার রাতে মুম্বাই কাস্টমস এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ওই যাত্রীর লাগেজ থেকে উদ্ধার করা সাপগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৪টি ইন্দোনেশিয়ান পিট ভাইপার এবং তিনটি স্পাইডার-টেইলড হর্নড ভাইপার। পিট ভাইপার প্রজাতির সাপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনে পাওয়া যায় এবং অত্যন্ত বিষাক্ত। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ান পিট ভাইপার তার রঙিন চামড়া এবং তীক্ষ্ণ বিষের জন্য পরিচিত।
স্পাইডার-টেইলড হর্নড ভাইপার নামটি এসেছে এদের লেজের অদ্ভুত আকৃতি থেকে। দেখতে অনেকটা মাকড়সার মতো। সাধারণত মরু অঞ্চল কিংবা শুষ্ক বনাঞ্চলে পাওয়া যায় এই সাপ। এই প্রজাতিও বিষাক্ত হলেও মূলত পাখি ও ক্ষুদ্র প্রাণী শিকারেই এদের আগ্রহ থাকে।
পাচারের অভিনব পদ্ধতি
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিপুলসংখ্যক সাপ চেক-ইন লাগেজের মধ্যে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি সাপ রাখা হয়েছিল ছোট ছোট প্লাস্টিক কনটেইনারে। সেগুলো আবার কাপড় দিয়ে ঢেকে ব্যাগের নিচের দিকে রাখা হয়েছিল যেন তাপমাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং বাহ্যিকভাবে কোনোভাবে শনাক্ত করা না যায়।
সাপগুলোর ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ছবিতে দেখা যায়, রঙিন সাপগুলো একটি বড় প্লাস্টিকের বালতিতে রাখা হয়েছে। নীল, হলুদ ও সবুজাভ রঙের এই সাপগুলো একে অপরের গায়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে রয়েছে।
কচ্ছপসহ আরও বিরল প্রাণী উদ্ধার
উদ্ধার হওয়া শুধু সাপেই সীমাবদ্ধ নয়। ওই যাত্রীর ব্যাগ থেকে পাওয়া গেছে পাঁচটি এশিয়ান লিফ টার্টলস বা পাতাজাতীয় কচ্ছপ। এশিয়ান লিফ টার্টল মূলত দক্ষিণ এশিয়ার নদী ও হ্রদে পাওয়া যায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত। এই কচ্ছপগুলো চামড়ায় পাতা আকৃতির নকশা থাকার কারণে সহজেই পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
আটক যাত্রীর পরিচয় গোপন
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ভারতীয় নাগরিকের পরিচয় এখনো প্রকাশ করা হয়নি। কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থে ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় এবং নাগরিক পাসপোর্ট নম্বর গোপন রাখা হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি কোনো আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচারচক্রের সদস্য এবং দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরনের অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত।
বিরল হলেও বাড়ছে পাচারের প্রবণতা
মুম্বাই বিমানবন্দরে সাধারণত এই ধরনের সরীসৃপ বা বন্যপ্রাণী উদ্ধারের ঘটনা খুব বেশি দেখা যায় না। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, তারা সাধারণত সোনা, নগদ অর্থ, মাদক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের অবৈধ আমদানির সঙ্গে বেশি familiar। তবে গত দুই বছর ধরে বন্যপ্রাণী পাচারের যে কটি ঘটনা সামনে এসেছে, তা উদ্বেগজনক।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা হচ্ছে—
- ফেব্রুয়ারি ২০২৫: মুম্বাই বিমানবন্দরে এক পাচারকারীর লাগেজ থেকে ৫টি সায়ামাং গিবন বানর উদ্ধার হয়। এই প্রজাতি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বনে বসবাস করে।
- নভেম্বর ২০২৪: থাইল্যান্ড থেকে আসা এক যাত্রীর ব্যাগে পাওয়া যায় ১২টি জীবন্ত কচ্ছপ।
- অক্টোবর ২০২৪: এক যাত্রীর লাগেজ থেকে উদ্ধার করা হয় চারটি হর্নবিল পাখি।
- সেপ্টেম্বর ২০২৪: দুটি লাগেজ থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচটি শিশু কাইম্যান (অ্যালিগেটর জাতীয় প্রাণী)। এই ঘটনায় অভিযুক্ত দুই যাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরিবেশবিদদের উদ্বেগ
এ ধরনের অবৈধ বন্যপ্রাণী পাচার আন্তর্জাতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে বলে মত দিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠন ‘উইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া’ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, পাচারকারীরা এখন আরও কৌশলী হচ্ছে এবং দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চোরাচালান আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক চাহিদা বাড়ার কারণে পাচারকারীরা বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের গোপনে বিদেশে পাচার করে। এতে শুধু যে এসব প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে তা-ই নয়, বরং এসব প্রাণী পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটির অনুপস্থিতি পুরো বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে।
আইনি ব্যবস্থা ও পরবর্তী করণীয়
ভারতের কাস্টমস আইন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় আটক যাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী পাচার আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়, এই মামলায় অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ৭ বছরের জেল ও অর্থদণ্ড।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানায়, উদ্ধার হওয়া প্রাণীদের মুম্বাইয়ের সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের সংরক্ষণ কেন্দ্রে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানে এই প্রাণীদের চিকিৎসা, পর্যবেক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেসব প্রাণী ফের বনে ছেড়ে দেওয়ার উপযোগী, তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাড়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান
ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ অভিযান ও নজরদারি জোরদার করা হবে। এছাড়া বিমানবন্দরে কাস্টমস স্ক্যানিং ব্যবস্থা আরও উন্নত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
পরিবেশ সচেতন মহলের দাবি, শুধু কাস্টমস পর্যায়ে নজরদারি বাড়ালেই হবে না, বরং আন্তর্জাতিকভাবে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।