বিশ্ব

‘চীন বোঝাতে চাইছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চলমান সফর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যযুদ্ধ ও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে চলমান টানাপোড়েনের মধ্যেই শি জিনপিং মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—চীনই হবে এই অঞ্চলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক ও কৌশলগত অংশীদার।

মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পৌঁছান প্রেসিডেন্ট শি। এর আগে সফরের প্রথম গন্তব্য ছিল ভিয়েতনাম, যেখানে চীন-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও গভীরতা আনতে নানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রেলপথ নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে সমঝোতা স্মারক বিনিময়ের মাধ্যমে চীন প্রমাণ করেছে, বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের আধিপত্য শুধু পশ্চিমা প্রভাব থেকে সরে আসছে না, বরং তা আরও বহুমাত্রিক ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে।

মালয়েশিয়ায় পৌঁছে প্রেসিডেন্ট শি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘চীন ও মালয়েশিয়ার মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কৌশলগত সহযোগিতা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে, সেই সঙ্গে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।’’ তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের পটভূমিতে চীন নতুন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতি মনোযোগী হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই সফর কেবল বাণিজ্যিক চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি এই অঞ্চলের জন্য একটি সুস্পষ্ট কূটনৈতিক বার্তা—ওয়াশিংটনের তুলনায় বেইজিং বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হতে চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি দিন দিন বৈচিত্র্যময় ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এবং চীন তা খুবই সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতিমালার অসংগতির কারণে এই অঞ্চলের দেশের মধ্যে একপ্রকার অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বেইজিং।

মালয়েশিয়ার সাবেক আইনমন্ত্রী এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ নজরী আবদুল আজিজ এই সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ‘‘চীন এই সফরের মাধ্যমে মূলত বোঝাতে চাচ্ছে—তারা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার। অতীতে চীনের সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের বড় ধরনের সমস্যা হয়নি। বরং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া ধীরে ধীরে চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক।’’

বিশ্লেষকদের অভিমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্ক দিন দিন নানা শর্ত এবং শুল্ক আরোপের কারণে জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ার রপ্তানি পণ্যের ওপর প্রায় ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, মালয়েশিয়া নাকি আমদানি করা মার্কিন পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। যদিও মালয়েশিয়া এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে।

এই দ্বন্দ্বের মধ্যে চীন সুযোগ নিচ্ছে তাদের ‘উইন-উইন কূটনীতি’র মাধ্যমে। শি জিনপিংয়ের সফরের মূল বার্তা হচ্ছে, চীন কেবল বিনিয়োগকারী বা রপ্তানিকারক নয়, বরং এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অংশীদার। এটি কৌশলগতভাবেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আজ আর শুধু ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বাণিজ্যিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি। এই অঞ্চলের দেশগুলো বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এই অঞ্চলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।

চীনের এই সফর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এর লক্ষ্যও সামনে নিয়ে এসেছে। মালয়েশিয়া এই উদ্যোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। শি জিনপিংয়ের সফরে বিআরআই সম্পর্কিত বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম স্পষ্টই জানিয়েছেন, তার সরকার চীনের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী শুল্কনীতি এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে কঠোর মনোভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের নমনীয় এবং অংশীদারিত্বমূলক কূটনীতি এই অঞ্চলকে আকৃষ্ট করছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং উদীয়মান বাজার হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া এই অঞ্চলে চীন নিজের অবস্থান মজবুত করার কৌশলে কোনো ফাঁক রাখছে না। শি জিনপিংয়ের সফর তারই বহিঃপ্রকাশ। এই সফর মালয়েশিয়া এবং চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পথে মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকার বেশ ইতিবাচক। কারণ, চীনের বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যমূলক শুল্ক, বাজার প্রবেশের বিধিনিষেধ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক মন্ত্রী নজরী আবদুল আজিজও সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। তার মতে, ‘‘দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে থাকবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব আরও দৃঢ় হবে।’’

চীনের এই সফর শুধু বাণিজ্যিক বন্ধন নয়, কৌশলগত জোট গঠনের দিকেও ইঙ্গিত করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চীন এই অঞ্চলের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট। এতে মালয়েশিয়া ছাড়াও ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গেও চীন তার কৌশলগত অবস্থান মজবুত করছে।

বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণে চীনের এই সফর তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যে চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক দৃঢ় করবে, সেই বার্তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। আর এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বার্তাটি অত্যন্ত চিন্তার কারণ।

চীনের এই সফর শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবে এই অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে আনতে পারবে কিনা—সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, চীন ধীরে ধীরে নিজেকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button