
বাংলাদেশ ক্রিকেটে গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে আরেকটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণ ও গণমাধ্যমে সমালোচনার কারণে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক তাওহীদ হৃদয়ের বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে, এই শাস্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনায় ক্রিকেট মহলে তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদসহ অন্যান্য ক্রিকেটারদের আপত্তি ও চাপের মুখে বিসিবি তাওহীদ হৃদয়ের বাকি এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিসিবি তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল, যা ক্রিকেট পাড়ায় নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত
গত ১২ এপ্রিল মিরপুরে আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে ডিপিএলের একটি ম্যাচে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলছিলেন তাওহীদ হৃদয়। ম্যাচ চলাকালীন আম্পায়ার তানভীর আহমেদের একটি এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্ত নিয়ে মোহামেডানের ক্রিকেটাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় তাওহীদ হৃদয় আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়ান, যা বিসিবির নিয়ম ভঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঘVRPটনায় তাওহীদের বিরুদ্ধে চারটি ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ করা হয় এবং তাকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানাসহ এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই ম্যাচে মোহামেডানের পেসার ইবাদত হোসেনকেও ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
ম্যাচ শেষে তাওহীদ হৃদয় গণমাধ্যমে আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকতের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, যা বিসিবির কোড অব কন্ডাক্টের আরেকটি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়। ফলে তার শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা করা হয় এবং অতিরিক্ত তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ করা হয়।
শাস্তি কমানো ও বিতর্ক
নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং তাওহীদ হৃদয় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে বিসিবি এবং ডিপিএলের টেকনিক্যাল কমিটি শাস্তি কমিয়ে এক ম্যাচে নামিয়ে আনে। এই সিদ্ধান্তের ফলে তাওহীদ অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচে খেলার সুযোগ পান, যা ক্রিকেট মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকে অভিযোগ করেন, মোহামেডানের চাপে বিসিবি নিয়ম ভঙ্গ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
সমালোচনার মুখে বিসিবি পুনরায় তাওহীদ হৃদয়ের শাস্তি দুই ম্যাচে পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাওহীদকে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ম্যাচে নিষিদ্ধ থাকতে হতো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তও বেশি দিন টেকেনি।
ক্রিকেটারদের আপত্তি ও বিসিবির নতুন সিদ্ধান্ত
২৫ এপ্রিল, ২০২৫, শুক্রবার মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ে ক্রিকেটারদের একটি প্রতিনিধি দল বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন। এই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমুল আবেদীন ফাহিম এবং আম্পায়ার্স ও মিডিয়া কমিটির প্রধান ইফতেখার রহমান মিঠু।
বৈঠকে তামিম ইকবালসহ অন্যান্য ক্রিকেটাররা তাওহীদ হৃদয়ের শাস্তি পুনর্বহালের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তামিম সাংবাদিকদের বলেন, “প্রথমে তাওহীদকে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হলে কোনো ক্রিকেটার এ নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু হঠাৎ গতকাল আবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এটা কোন নিয়মে হলো, তা আমি জানি না। এটা খুবই হাস্যকর। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই নিষেধাজ্ঞা হতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, “যদি কোনো ক্রিকেটার ভুল করে, আমরা চাই তার শাস্তি হোক। কিন্তু শাস্তির প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য হতে হবে।”
ক্রিকেটারদের এই আপত্তি ও চাপের মুখে বিসিবি তৃতীয়বারের মতো তাওহীদ হৃদয়ের শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। বিসিবির একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গত ১৯ এপ্রিল আম্পায়ার্স কমিটির দেওয়া শাস্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের পর দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হয়েছিল। তবে, পরবর্তী আদেশের বিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় টেকনিক্যাল কমিটি পুনর্বিবেচনা করে শাস্তি কার্যকরের সময় এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই শাস্তি পরবর্তী ডিপিএলের প্রথম ম্যাচে কার্যকর হবে।”
শাস্তি পিছানোর প্রভাব
বিসিবির এই সিদ্ধান্তের ফলে তাওহীদ হৃদয় এবারের ডিপিএলের সুপার লিগে মোহামেডানের হয়ে বাকি দুই ম্যাচে অংশ নিতে পারবেন। আগামীকাল, ২৬ এপ্রিল, গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে মোহামেডানের ম্যাচে তিনি মাঠে নামতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জন্য স্বস্তির হলেও, বিসিবির বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনা ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ক্রিকেট মহলের প্রতিক্রিয়া
তাওহীদ হৃদয়ের শাস্তি নিয়ে বিসিবির এই ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ক্রিকেট মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। একদিকে, ক্রিকেটারদের আপত্তি ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, ক্রিকেটারদের এই পদক্ষেপ বিসিবির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে, বিসিবির বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনাকে অনেকে প্রশাসনিক দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন। ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রশাসনিক কাঠামোর উপর ভক্ত ও স্টেকহোল্ডারদের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
তাওহীদ হৃদয়ের ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ
তাওহীদ হৃদয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটার। ২০১৭ সালে রাজশাহী বিভাগের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের পর তিনি দ্রুতই জাতীয় দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে অভিষেক এবং একই বছর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে ৯২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এছাড়া, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগে জাফনা কিংসের হয়ে অভিষেক ম্যাচে অর্ধশতক করে তিনি আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন।
তবে, এই বিতর্ক তার ক্যারিয়ারে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্রিকেট বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাওহীদের মতো তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য মাঠের আচরণ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগে আরও সতর্কতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে, বিসিবির পক্ষ থেকে স্পষ্ট নীতিমালা ও স্বচ্ছ শাস্তি ব্যবস্থা এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।