উত্তর কোরিয়া আবারও তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করল। কোরীয় উপদ্বীপে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে দেশটি নতুন দুটি আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি (KCNA) এ তথ্য জানিয়েছে।
গত শনিবার (২৩ আগস্ট) এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে ঠিক কোন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। পরীক্ষার সময় দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উন নিজে উপস্থিত ছিলেন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
KCNA জানিয়েছে, নতুন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এবং এর কার্যপ্রণালি অনন্য। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম এবং আকাশসীমায় লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে অত্যন্ত কার্যকর।
প্রকাশিত ছবিগুলোতে দেখা গেছে, কিম জং-উন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং এক পর্যায়ে একটি লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করছে। ছবিতে আরও দেখা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে গিয়ে আকাশে বিস্ফোরিত হচ্ছে, যা এর উচ্চ প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।
কেন এই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা উত্তর কোরিয়ার বর্ধিত সামরিক কৌশলের অংশ, বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া, যুদ্ধবিমান মোতায়েন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারের কারণে উত্তর কোরিয়া বারবার হুমকির মুখে পড়েছে বলে দাবি করছে।
কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক হং মিন বলেছেন—
“রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে উত্তর কোরিয়া নতুন শিক্ষা নিয়েছে। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে তারা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই নতুন সিস্টেম মূলত ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। কারণ আধুনিক যুদ্ধে ড্রোন আক্রমণ বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তে নতুন উত্তেজনা
ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগেই সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গত সপ্তাহে প্রায় ৩০ জন উত্তর কোরীয় সেনা সীমান্ত অতিক্রম করলে দক্ষিণ কোরীয় সেনারা সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ে।
এই ঘটনার পর পিয়ংইয়ংয়ের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। উত্তর কোরিয়ার সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল কো জং চোল এক বিবৃতিতে বলেন—
“এটি ছিল পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত উসকানি।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয় জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব
এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুধু কোরীয় উপদ্বীপেই নয়, পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ। কারণ—
- উত্তর কোরিয়া যদি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জ।
- যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও সামরিক উপস্থিতির কারণে উত্তরের প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হচ্ছে।
- সাম্প্রতিক রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া সম্পর্কও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি হওয়ার পর থেকে উত্তর কোরিয়ার সামরিক সক্ষমতা উন্নত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে?
যদিও উত্তর কোরিয়া বিস্তারিত কিছু জানায়নি, তবে সামরিক বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে থাকতে পারে—
✔ উচ্চগতির প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা
✔ একাধিক লক্ষ্যবস্তু একসঙ্গে ধ্বংসের ক্ষমতা
✔ উন্নত রাডার ও সেন্সর প্রযুক্তি
✔ ক্ষুদ্র ড্রোন এবং কম উচ্চতায় উড়ন্ত ক্রুজ মিসাইল মোকাবিলার সক্ষমতা
যদি এসব বৈশিষ্ট্য সত্যি হয়, তবে এটি উত্তর কোরিয়ার জন্য বড় অগ্রগতি। কারণ এতদিন পর্যন্ত দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরনো প্রযুক্তিনির্ভর ছিল।
উত্তর কোরিয়ার সামরিক মহড়ার ইতিহাস
উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একাধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী আলোচনায় উঠে আসে। সেগুলোর মধ্যে কিছু পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনক্ষম বলেও ধারণা করা হয়।
তবে এইবারের পরীক্ষা আলাদা, কারণ এটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়। সাধারণত উত্তর কোরিয়া আক্রমণাত্মক মিসাইলের দিকে জোর দেয়, কিন্তু এবার প্রতিরক্ষায় জোর দিচ্ছে, যা নতুন কৌশলগত পরিবর্তন নির্দেশ করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার এমন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে উত্তর কোরিয়া সবসময় দাবি করে, এটি তাদের স্বাধীন প্রতিরক্ষা অধিকার।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
উত্তর কোরিয়ার কৌশল কোথায় যাচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরীক্ষা প্রমাণ করে উত্তর কোরিয়া শুধু আক্রমণাত্মক ক্ষমতা নয়, বরং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও শক্তিশালী করছে। কারণ আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল বড় হুমকি। তাই আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা উত্তর কোরিয়ার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
MAH – 12457 , Signalbd.com



