“আগামী নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সর্বোত্তম” — আশাবাদী প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন—আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে “সর্বোত্তম” এবং এটি গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক।
এই মন্তব্য তিনি করেন শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়, এশিয়ার অন্যতম নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (এএনএফআরইএল)-এর একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে।
ড. ইউনূসের বক্তব্য: নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে ইতিহাসের সেরা। আমরা এমন একটি নির্বাচন করতে চাই, যা দেশের মানুষ গর্বের সঙ্গে স্মরণ করবে। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। কেউ যেন প্রক্রিয়া থেকে বাদ না পড়ে।”
তিনি আরও জানান, ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬-এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে সব সংস্থা, রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এএনএফআরইএলের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা
এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন:
- ব্রিজা রোসালেস — নির্বাহী পরিচালক, এএনএফআরইএল
- মে বুটয় — বাংলাদেশ নির্বাচন ও গণতন্ত্র কর্মসূচির পরামর্শক
- থারিন্ডু আবেরত্না — সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার
- আয়ান রহমান খান — প্রোগ্রাম অফিসার
- আফসানা আমেই — প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট
তারা প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনী রোডম্যাপ ও অঙ্গীকার শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তারা জানান, বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারা পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
গণতন্ত্র রক্ষায় নতুন সূচনা
গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়। এই আন্দোলনের ফলেই ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংলাপ এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছেন।
এএনএফআরইএল: একটি আঞ্চলিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা
এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (ANFREL) হলো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত একটি নাগরিক সংগঠন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, সুশাসন এবং নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা অতীতেও বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সুপারিশ দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ: কেমন হতে পারে নির্বাচন?
ড. ইউনূসের সরকারের অধীনে নির্বাচন বাস্তবায়নের জন্য নিচের বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে—
- স্বাধীন নির্বাচন কমিশন — কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ও শক্তিশালী করা হচ্ছে।
- নিরাপত্তা ব্যবস্থা — ভোটার, প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা।
- স্বচ্ছ ভোটার তালিকা — মৃত ও ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে হালনাগাদ তালিকা।
- ডিজিটাল মনিটরিং — অনিয়ম ঠেকাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা।
- আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আমন্ত্রণ — যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সার্কসহ বিভিন্ন সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের রোডম্যাপ সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপি এবং তাদের সহযোগী দলগুলো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপর জোর দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নির্বাচনের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশবাসীর প্রত্যাশা
বিগত নির্বাচনে ভোটের স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। এবার সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা—
- কারচুপি ও সহিংসতামুক্ত ভোট
- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান
- প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া
রাজধানীর এক ভোটার বললেন, “আমরা চাচ্ছি এবার সত্যিকারের একটা ভোট হোক। যেই আসুক, জনগণের রায় যেন প্রতিফলিত হয়।”
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। একদিকে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠার প্রত্যাশা, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্নির্মাণের সুবর্ণ সুযোগ।
এখন সময় কার্যকর বাস্তবায়নের। যদি সব পক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করে, তবে ২০২৫-২৬ সালের নির্বাচন সত্যিই হয়ে উঠতে পারে “বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোত্তম নির্বাচন”।