বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে প্রস্তুত ঢাকা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে স্পষ্টভাবে জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন খাতে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। এতে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং নতুন সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঘটনার বিস্তারিত
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডান লিঞ্চের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অপরদিকে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশীর উদ্দিন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মুরশেদ, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন।
আলোচনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা ও সয়াবিন আমদানি। পাশাপাশি এলপিজি গ্যাস সরবরাহ, সিভিল এয়ারক্রাফট ক্রয় এবং মাদক নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা বিষয়েও আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে। তবে দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে বিভিন্ন শুল্ক ও বিধিনিষেধের মুখে পড়ে।
এর আগে একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশ শুল্ক সুবিধা পাওয়ার দাবি জানালেও এখনও পূর্ণাঙ্গ সমাধান হয়নি। তাই এবার বাংলাদেশ পক্ষ থেকে নতুন করে আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আমদানির নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করে, যার বড় অংশই ভারত ও আফ্রিকা থেকে আসে। এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে ঢাকা।
একইভাবে ভোজ্যতেল উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে সয়াবিন আমদানিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইনে বৈচিত্র্য আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জ্বালানি ও পরিবহন সহযোগিতা
বৈঠকে আলোচিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জ্বালানি নিরাপত্তা। বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধমান চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলপিজি আমদানিতে আগ্রহী। এছাড়া দেশের বিমান পরিবহন খাতকে আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিভিল এয়ারক্রাফট কেনার পরিকল্পনার কথাও আলোচনায় উঠে আসে।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির সুযোগ বাড়ালে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ শুল্ক ছাড় বা অন্যান্য বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও শক্ত অবস্থানে যেতে পারবে।
অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যের উপস্থিতি বাড়লে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এতে ভোক্তারা উপকৃত হলেও স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
পরিসংখ্যান ও তুলনা
- যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার।
- ২০২৪ সালে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২০০ কোটি ডলার।
- এর মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে ৮০০ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য, আর আমদানি করে প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য।
- ফলে বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই বেশি।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী আমদানির বাজার তৈরি করা জরুরি। ভারত বা চীননির্ভরতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পথ খুলে দেওয়া কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে রপ্তানিতে শুল্ক ছাড় বা বাজার সম্প্রসারণ ছাড়া বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লাভ হবে না। তাই আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমান সুযোগ তৈরি করাও প্রয়োজন বলে তারা মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছানোর পথে। কৃষিপণ্য, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে আমদানির নতুন উদ্যোগ দুই দেশের জন্যই ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—রপ্তানিতে যে শুল্ক বাধা রয়েছে, সেটি কবে কাটবে? ভবিষ্যৎ বাণিজ্য সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করছে এর সমাধানের ওপর।
এম আর এম – ১৩৪৫,Signalbd.com