কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদের আগাম আনন্দ: ঘরমুখো মানুষের ঢল

পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন হাজারো মানুষ। নিজ নিজ প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে প্রতিদিনের মতো বুধবার সকালেও কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমেছে ঘরমুখো মানুষের ঢল। তবে এবার স্বস্তির বিষয় হলো—এখন পর্যন্ত কোনো ট্রেনের শিডিউলে বিপর্যয় ঘটেনি।
ঘরমুখো মানুষের স্রোত, মুখে হাসি
ঈদের ছুটির শুরুতে স্টেশনে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে হাজার হাজার যাত্রী স্টেশনে উপস্থিত হন। নারী, শিশু, বয়স্ক—সব বয়সী মানুষ ছিল সেই জনস্রোতে। কেউ ছাতা মাথায় করে, কেউ ব্যাগে করে খাবার ও কাপড়চোপড় নিয়ে স্টেশনে হাজির হয়েছেন বহু আগে থেকেই।
তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার যাত্রীরা তুলনামূলক স্বস্তিতে রয়েছেন। ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ছে, টিকিট চেকিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো বলেই জানালেন অনেকে।
ট্রেনের সময়সূচি যথাসময়ে, বিপর্যয় শূন্য
ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. সাজেদুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১৫টি ট্রেন নির্ধারিত গন্তব্যে ছেড়ে গেছে এবং সারাদিনে মোট ৬৩টি ট্রেন ছাড়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বস্তিকর ঈদযাত্রা উপহার দিতে।’
তিন স্তরের নিরাপত্তা, টিকিট চেকিং জোরদার
ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবার তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। টিকিট চেকিংয়ের পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। যাত্রীদের সাথে অতিরিক্ত মালামাল বা টিকিটবিহীন কেউ যাতে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে র্যাব, পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বয়ে কঠোর নজরদারি চালানো হচ্ছে।
স্টেশন ম্যানেজার জানান, ‘আমরা তিন স্তরের চেকিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছি। কোনোভাবে যেন কালোবাজারি বা ভুয়া টিকিটধারীরা স্টেশনে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নিয়মিত অভিযান চলছে।’
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা: ‘চেষ্টা আছে, ভোগান্তি কম’
ভোর ৫টায় স্টেশনে এসেছেন খুলনাগামী যাত্রী মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম অনেক ভোগান্তি হবে। কিন্তু সময়মতো ট্রেন ছাড়ছে দেখে ভালো লাগছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও বেশ ভালো।’
একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী যাত্রী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘অনলাইনে টিকিট কেটেছিলাম। আজ নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট আগেই স্টেশনে চলে এসেছি। তেমন ভোগান্তি হয়নি।’
রেলওয়ের বিশেষ ব্যবস্থা
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে ৫ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামলাতে প্রতিদিন বিশেষ ট্রেন চলবে। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে এই ট্রেনগুলো চলাচল করবে। সেইসঙ্গে যাত্রীসেবা নিশ্চিতে অতিরিক্ত কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে স্বাস্থ্যসেবা পয়েন্ট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা এবং প্রবীণ ও শিশুদের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবক দলও কাজ করছে।
কালোবাজারি ঠেকাতে মোবাইল কোর্ট
রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) আহমেদ হোসেন জানান, কালোবাজারি ঠেকাতে প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি অভিযানে অনেক টিকিট কালোবাজারিকে আটক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের অনুরোধ করছি, টিকিটের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে।’
ছুটির হিসাব: ৭ জুন থেকে মূল চাপ
চলতি বছর সরকারি ছুটি ৭ জুন (শুক্রবার) থেকে শুরু হওয়ায় মূল যাত্রীচাপ ৬ জুন থেকে শুরু হবে বলে মনে করছেন রেল কর্মকর্তারা। যারা ৭ জুন ছুটির আগে গ্রামে ফিরতে চাইছেন, তারা আগেভাগেই টিকিট কেটে রওনা দিচ্ছেন।
ট্রেনের তালিকা ও গন্তব্য
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঈদ উপলক্ষে ঢাকার কমলাপুর থেকে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতিদিন প্রায় ৬৩টি ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়াও রয়েছে মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: রেলপথে যাত্রা আরও সহজ করতে পদক্ষেপ
বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজি সাঈদা খানম বলেন, ‘রেলের উপর যাত্রীদের আস্থা বাড়ছে। তাই প্রতি ঈদেই যাত্রীসেবা উন্নয়নে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আগামীতে প্রতিটি বড় স্টেশনে ই-গেট, ই-টিকিটিং এবং সিসিটিভি মনিটরিং সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।’
স্বস্তির ঈদযাত্রা চাইলে রেলই ভরসা
যে কোনো উৎসবেই মানুষ বাড়ি ফিরতে চায় স্বস্তিতে, নিরাপদে ও সঠিক সময়ে। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে এবার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ প্রস্তুত বলেই মনে হচ্ছে। শিডিউল বিপর্যয় না থাকায় যাত্রীদের মুখে হাসি, স্বস্তির ঈদযাত্রা এখন আর শুধু কল্পনা নয়—বাস্তবতা।