আর্থিক খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে: অর্থ উপদেষ্টা

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালকে আর্থিক খাতের জন্য ‘নজিরবিহীন লুটপাট ও অপশাসনের যুগ’ আখ্যা দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই সময়কালে নেওয়া অপরিকল্পিত ও দুর্নীতিপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কার্যত ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনকালে জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে এসব মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “বিগত সরকার আর্থিক খাতকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থসাধনের জন্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অসাধু ঋণ বিতরণ, ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের নামে খেলাপিদের সুবিধা প্রদান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিস্ক্রিয়তা এই খাতকে আজ ভয়াবহ সংকটে ফেলেছে।”
কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও সরকারের পদক্ষেপ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন সরকারের অর্থনৈতিক নীতি নতুন করে নির্ধারিত হয় এবং আর্থিক খাত সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
এই অধ্যাদেশের আওতায় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট এবং অস্তিত্বের ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন ও সংহালন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্যও আইনগত নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে।
টাস্কফোর্স গঠন ও সম্পদের মান নিরূপণ
অর্থ উপদেষ্টা জানান, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এসব টাস্কফোর্সের কাজ হলো ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত পর্যালোচনা করা, নীতিমালা ও প্রবিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।
তিনি বলেন, “যেসব ব্যাংক পুঁজির ঘাটতিতে ভুগছে, যাদের খারাপ ঋণের পরিমাণ অত্যধিক, এবং যেসব ব্যাংকে আর্থিক অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে—সেসব ব্যাংকের অবস্থা যাচাই করে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা, পুনর্গঠন অথবা একত্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে।”
চুরি ও পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে উদ্যোগ
বিগত সরকারের আমলে দেশীয় সম্পদের বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে দাবি করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, “আমরা এই সম্পদ উদ্ধারে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে চিহ্নিত সম্পদের তথ্য সংগ্রহ, আইনি সহায়তা চুক্তি এবং পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করেছে এবং পাচার হওয়া অর্থের উৎস ও প্রাপক চিহ্নিত করতে কার্যকর অনুসন্ধান পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।
খেলাপি ঋণ: প্রকৃত চিত্র
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় একটি সংকটের নাম খেলাপি ঋণ। অর্থ উপদেষ্টার ভাষায়, “বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বড় অংকের ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই ফেরত আসেনি। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে গভীর তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “২০২৩ সালের জুন মাসে যেখানে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, সেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। এর প্রধান কারণ হলো বারবার ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ করে আর্থিক খাতের প্রকৃত দুর্বলতা আড়াল করা। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণের শ্রেণীকরণ পদ্ধতি প্রণয়ন করেছি এবং খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর আইন বাস্তবায়ন করছি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকায় জোর
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সক্ষমতার অভাব দেখা দেয়। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছে এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি আধুনিক ও তথ্যভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রূপান্তরের পরিকল্পনাও বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরেন তিনি। এর মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজারব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতা বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থ উপদেষ্টা।
আস্থা ফিরিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর বক্তৃতার শেষাংশে বলেন, “আমরা জানি যে আস্থা একটি আর্থিক ব্যবস্থার প্রান। তাই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ যেন নিরাপদ থাকে, সেটিই আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে খুব শিগগিরই আমরা একটি সুস্থ, টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক খাত গড়ে তুলতে পারব। আমাদের বিশ্বাস, এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে।”
অর্থ উপদেষ্টার এই বক্তৃতা শুধু একটি বাজেট ঘোষণার অংশ নয়, বরং আর্থিক খাতকে সুস্থ ও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর রূপরেখা হিসেবেই এটি বিবেচিত হচ্ছে।