বিশ্ব

গাজায় খাদ্য সংকটে মৃত্যু ঝুঁকিতে ৬৫ হাজার শিশু

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খাদ্যের তীব্র সংকটের কারণে এখন মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় ৬৫ হাজার শিশু। অঞ্চলটিতে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা অবরোধে ত্রাণ, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন খাবার সংকট, তেমনি অন্যদিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।

এই তথ্য জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর, যারা গাজার প্রশাসনের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের অভিযোগ

গাজার জনসংযোগ বিভাগ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে গাজায় দুর্ভিক্ষ তৈরি করছে। দেশটি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে পদ্ধতিগত অপরাধ চালাচ্ছে। সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে টানা ৭০ দিন ধরে, যার ফলে অন্তত ৩৯ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে পারেনি।

বিবৃতিতে বলা হয়, এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। অবরোধের কারণে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ—তিনটি জরুরি খাতেই মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, অসুস্থ মানুষ এবং বৃদ্ধরা।

বন্ধ বেকারিগুলো, খাদ্য সংকটে জনজীবন

বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, গাজার সব বেকারি গত ৪০ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে রুটি ও অন্যান্য প্রধান খাদ্য উপাদান পাওয়া যাচ্ছে না। রুটি গাজার প্রধান খাদ্য, এবং এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

এই অবস্থাকে একটি পরিকল্পিত মানবিক বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ক্ষুধাকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। খাবার এবং অপুষ্টির কারণে মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে ৬৫ হাজারেরও বেশি শিশু। অনেকেই অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

মানবিক সংকটে মৃত্যুর মিছিল

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, অক্টোবর থেকে চলমান এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৫২ হাজার ৮১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১২৪ জন।

সবমিলিয়ে আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৩ জনে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন। অনেক মরদেহ এখনো সড়কে পড়ে আছে যাদের উদ্ধারে কেউ পৌঁছাতে পারছেন না।

যুদ্ধবিরতির পর নতুন করে হামলা

গত ১৮ মার্চ ইসরায়েল গাজায় পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করে। এর পর থেকে শুধু এই সময়েই ২ হাজার ৭০১ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৭ হাজার ৪৩২ জন আহত হয়েছেন। এই হামলা ভেঙে দিয়েছে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তি।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নেই, ক্ষুব্ধ মানবাধিকার কর্মীরা

গাজার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে তা এখন আর শুধু যুদ্ধ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক বিপর্যয়। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও পর্যন্ত যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই নীরবতাকে সহযোগিতামূলক অপরাধ হিসেবে দেখছে।

ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেড ক্রসসহ অনেক সংস্থা ইসরায়েলের এই অবরোধ এবং হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গাজার জনগণের দুর্ভোগ কমছে না।

শিশুদের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিশুদের জন্য দ্রুত খাবার, পানি ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো। অপুষ্টি প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বহু শিশু মৃত্যুর মুখে পড়বে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা, যা এই মুহূর্তে গাজায় প্রায় অনুপস্থিত।

গাজা উপত্যকার অবরোধ শুধু একটি সামরিক কৌশল নয়, বরং এটি একটি ভয়ঙ্কর মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। শিশুদের মতো সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠী এখন এই সংঘাতের প্রধান শিকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে গাজায় অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং জরুরি ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর তা না হলে, সামনে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে গোটা ফিলিস্তিন।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button