বিশ্ব

গাজার উদ্দেশ্যে এগোচ্ছে বহর, ইসরায়েল আটকাল ১৩ নৌযান

Advertisement

গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে মানবিক সংকটের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক বহরের ঘটনা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামক এই বহর, যা গাজার জনগণের কাছে খাদ্য, ওষুধ এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা করেছিল, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হাতে আটকে পড়েছে। বৃহস্পতিবার (১–২ অক্টোবর ২০২৫) ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ১৩টি নৌযান আটক করেছে, যাতে কয়েকশো স্বেচ্ছাসেবী, সংসদ সদস্য এবং আন্তর্জাতিক পরিচিত মানবাধিকার কর্মীরা ছিলেন। তবুও বহরের প্রায় ৩০টি জাহাজ গাজার উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে বলে ঘোষণা করেছে সংগঠনের নেতৃত্ব। এই ঘটনা শুধু সামুদ্রিক সংঘর্ষ নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং কূটনীতির একটি জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

এই বহরের পেছনে রয়েছে গাজার দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ এবং যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়। ইসরায়েলের দাবি, এই বহর নিরাপত্তার জন্য হুমকি, যখন সমর্থকরা এটিকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বলে দাবি করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা ঘটনার বিস্তারিত চিত্র, প্রেক্ষাপট, আইনি দিক এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। রয়টার্স, অ্যাল জাজিরা, এপি নিউজ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণ প্রস্তুত করা হয়েছে। গাজার সংকটের এই নতুন অধ্যায় কীভাবে বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে, তা দেখার বিষয়।

ফ্লোটিলার উদ্দেশ্য ও যাত্রার পটভূমি

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক জোটের উদ্যোগ, যাতে ফ্রিডম ফ্লোটিলা ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা, মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা এবং সুমুদ নুসানতারা সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ রয়েছে। এই বহরের মূল উদ্দেশ্য দুটি: প্রথমত, গাজার অবরোধ ভেঙে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া; দ্বিতীয়ত, সমুদ্রপথে একটি প্রতীকী ‘মানবিক করিডোর’ তৈরি করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। জাহাজগুলোতে ছিল খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং শিশুদের জন্য খেলনা—যা গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়।

যাত্রা শুরু হয় ৩১ আগস্ট ২০২৫ স্পেনের বার্সেলোনা বন্দর থেকে। প্রায় ৪৩টি জাহাজে ৫০০-এর বেশি নাগরিক যাত্রা করেন, যারা ৪৪টি দেশ থেকে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সংসদ সদস্য, আইনজীবী, পরিবেশকর্মী এবং সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক। ভূমধ্যসাগরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বহর গাজার উপকূলের কাছে পৌঁছায়, কিন্তু ইসরায়েলের নৌনিষেধ এলাকায় প্রবেশের চেষ্টায় আটকে পড়ে। ফ্লোটিলার নেতৃত্ব বলেছে, “এটি শুধু সহায়তা নয়, বরং গাজার মানুষের অধিকারের প্রতীকী লড়াই।” অ্যাল জাজিরার রিপোর্ট অনুসারে, এই বহরের মতো প্রচেষ্টা গাজার অবরোধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ায়, যা ২০০৭ সাল থেকে চলছে।

ইসরায়েলের পদক্ষেপ: রাতের অন্ধকারে আটক অভিযান

বহর যখন গাজার উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন ইসরায়েলি নৌবাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে তারা ১৩টি নৌযানকে ঘিরে ফেলে এবং বোর্ডিং অভিযান চালায়। রয়টার্সের সূত্র অনুসারে, ইসরায়েলি কমান্ডোরা জাহাজগুলোতে উঠে যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং তাদের আশদোড (Ashdod) বন্দরে নিয়ে যায়। আটক যাত্রীদের সংখ্যা ২০০-এর বেশি, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, যদিও ইসরায়েল এটি অস্বীকার করেছে।

ইসরায়েলের দাবি, এই বহর “সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে” অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করেছে এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তারা বলেছে, জাহাজগুলোতে অস্ত্র বা বিস্ফোরক ছিল কিনা তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফ্লোটিলার পক্ষ বলছে, এটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ অভিযান এবং আটকগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘটেছে, যা অবৈধ। স্কাই নিউজের লাইভ ফুটেজে দেখা গেছে, জাহাজগুলোর চারপাশে ইসরায়েলি জাহাজগুলো ঘিরে ফেলে এবং ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করে। এই ঘটনা গাজার অবরোধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।

গ্রেটা থুনবার্গের ভূমিকা: আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু

এই বহরের সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি ফ্লোটিলারের একটি জাহাজে যাত্রা করছিলেন এবং ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুসারে, গ্রেটাকে আশদোড বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তার শারীরিক অবস্থা “নিরাপদ ও সুস্থ” বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গ্রেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “আমরা গাজার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এই অবরোধ অমানবিক এবং আমরা এটি ভাঙব।” তার উপস্থিতি ঘটনাটিকে পরিবেশ, মানবাধিকার এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে।

গ্রেটার পাশাপাশি অন্যান্য উচ্চপ্রোফাইল ব্যক্তিত্ব যেমন ইউরোপীয় সংসদ সদস্য, আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরা আটক হয়েছেন। এটি শুধু সংখ্যাগত নয়, বরং প্রতীকী—কারণ এই ব্যক্তিরা বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী। স্কাই নিউজের মতে, গ্রেটার আটকের খবর ছড়াতেই সামাজিক মিডিয়ায় #FreeGretaGaza হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হয়েছে, যা ঘটনার প্রভাব বাড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু

ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সংগঠন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং ইটালির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নাগরিকদের আটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে এবং কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে। কলম্বিয়া এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বলেছে, “এই আটকগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।” রয়টার্সের সূত্র অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লীগও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এই প্রতিক্রিয়া শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক। আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন করলেও, অনেকে মানবিক সহায়তার পথ খোলার দাবি করছেন। থ গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ঘটনা গাজার অবরোধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ককে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।

আইনগত ও নৌসীমা সংক্রান্ত বিতর্ক: কার আইন লঙ্ঘন?

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসারে, একটি দেশের নৌনিষেধ অধিকার ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফ্লোটিলারের দাবি, আটকগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘটেছে, যা অবৈধ। ইসরায়েল বলছে, গাজা “সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র” এবং নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক নৌনিষেধ প্রযোজ্য। এপি নিউজের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই বিতর্ক আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে, যেমন ২০১০ সালের মাভি মার্মারা ঘটনায় হয়েছিল।

আইনজীবীরা বলছেন, যদি জাহাজগুলোতে কোনো অস্ত্র না পাওয়া যায়, তাহলে আটকগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। এই বিতর্ক গাজার অবরোধের বৈধতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

বহরের অভিজোগ: প্রযুক্তি ও শারীরিক বাধা

ফ্লোটিলার সদস্যরা অভিযোগ করেছেন যে, ইসরায়েলি নৌবাহিনী জাহাজগুলোর GPS এবং ট্রান্সপন্ডার জ্যাম করেছে, ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করেছে এবং ড্রোন থেকে স্টান গ্রেনেড-জাতীয় পদার্থ ছুড়েছে। স্কাই নিউজের ভিডিওতে দেখা গেছে, যাত্রীরা চিৎকার করে সাহায্য চেয়েছে। ইসরায়েল বলছে, এগুলো “নিরাপত্তা ব্যবস্থা” এবং কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়নি। এই অভিযোগগুলো সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ জাগিয়েছে।

MAH – 13119 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button