বিশ্ব

গাজায় পানির খোঁজে যাওয়া ছয় শিশুকে হত্যা করল ইসরায়েল

মধ্যপ্রাচ্যের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্মম হামলায় ছয়টি শিশুসহ অন্তত দশজন নিহত হয়েছেন। তারা সবাই খাবার ও পানির জন্য পানি সংগ্রহ করতে গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি পানি সরবরাহকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। স্থানীয় সূত্র ও আল-জাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। পানির তীব্র অভাবের মাঝে এই হত্যাযজ্ঞটি ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো ইসরায়েলি নৃশংসতার এক নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গাজার পানির তীব্র সংকট ও হত্যাযজ্ঞের পটভূমি

গাজায় পানির ভীষণ সংকটের মধ্যেই গত কয়েক মাসে প্রায় ১০ বার ফিলিস্তিনি শিশুসহ সাধারণ মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচার গুলি ও বোমাবর্ষণে লক্ষ্য করেছে। আজ রোববার মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি পানি সরবরাহ কেন্দ্রে হামলার সময় অন্তত ছয় শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন এবং কমপক্ষে ১৬ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই পানি সরবরাহকেন্দ্রের পানি পানযোগ্য নয়, ফলে মানুষকে নিরাপদ পানির জন্য অন্যত্র যেতে হয়।

গাজায় চলমান এই সংকটের মধ্যে পানি সংগ্রহ করাটাই এখন প্রাণঘাতী রোলার কোস্টার। ইসরায়েলি বাহিনী তীব্র নিরাপত্তা অবরোধ ও সামরিক হানায় পুরো উপত্যকাটি ঘিরে রেখেছে, ত্রাণ ও পানির প্রবাহ বন্ধ রেখেছে। এতে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত জীবন ঝুঁকিতে ফেলছেন।

গাজার নৃশংস হামলা ও নিহতের সংখ্যা

গাজার হাসপাতাল ও চিকিৎসা সূত্র থেকে জানা গেছে, আজকের হামলায় নিহত ১০ জনের মধ্যে অন্তত ছয়জন শিশু। এছাড়া গত কয়েক মাসে, চলতি বছর গাজায় ইসরায়েলের হামলায় মোট ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি।

গতকাল শনিবার গাজায় আরও ১১০ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৪ জন গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করার সময় নিহত হয়েছেন। এই ফাউন্ডেশন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পরিচালিত হয়। তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের পদ্ধতি ও খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

অনাহারে শিশুদের মৃত্যুর করুণ পরিসংখ্যান

ইসরায়েলের ১১ সপ্তাহের অবরোধের পর গত ২৬ মে থেকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ শুরু হয়, তবে সেটিও মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউ) জানাচ্ছে, মার্চ মাস থেকে গাজায় অপুষ্টির মাত্রা ভয়াবহ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে ৬৭ শিশুর অনাহারে মৃত্যু হয়েছে।

গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। খাদ্য ও পানির অভাব, স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে গাজার সাধারণ মানুষ বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য জীবন হয়ে উঠেছে এক অকল্পনীয় যন্ত্রণা।

সংঘাতের পটভূমি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে এক মারাত্মক হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজার উপর নৃশংস বোমা বর্ষণ ও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন, এবং ইসরায়েল প্রায় ২৫০ জনকে গাজায় বন্দি করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার কারণ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ ইসরায়েলের অবরোধ ও হামলাকে যুদ্ধবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনেতারা যুদ্ধবিরতির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

যুদ্ধবিরতির আশায় দোহায় আলোচনার ব্যর্থতা

৬ জুলাই থেকে কাতারের দোহায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তবে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেছেন, হামাস তাদের চাওয়া সেনা প্রত্যাহার নিয়ে অস্বীকৃতি জানায় এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত মানচিত্রে নতুন সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

মধ্যস্থতাকারীরা আলোচনাকে স্থগিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের আগমনের আগ পর্যন্ত আলোচনার গতি বন্ধ থাকবে। তবে ইসরায়েল হামাসকে দোষারোপ করেছে আলোচনায় নরম হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য।

গাজায় মানবিক সংকট: বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ

গাজার অবরোধ, খাদ্য ও পানির তীব্র অভাব, এবং ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ একটি ভয়াবহ মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। শিশু ও নারীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ বিপন্ন। চিকিৎসা সুবিধার অভাব ও ত্রাণ সরবরাহের অনিয়মে প্রতিদিন নতুন নতুন প্রাণহানি ঘটছে।

বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশের সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং তাত্ক্ষণিক মানবিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে।

গাজার শিশুরা পানির জন্য গিয়েও যখন প্রাণ হারাচ্ছে, তখন গোটা বিশ্বের দৃষ্টি একদিকে গাজার মানবিক সংকটের দিকে ফিরছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে গাজার বাঁচা মানুষের জীবন ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে পড়বে। শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অবরোধ তুলে নেওয়া ছাড়া গাজায় স্থায়ী সমাধান আসবে না।

আপডেটেড খবর ও বিশ্লেষণের জন্য সিঙ্গলবিডি ডট কম-এ নজর রাখুন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button