
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরের অংশ হিসেবে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেবেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সফরকে ঘিরে নানা আলোচনা চলছে, বিশেষ করে দেশের বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ সফরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।
সফরের বিস্তারিত পরিকল্পনা
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে জানান, প্রধান উপদেষ্টা ২১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। সেখানে পৌঁছে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেবেন।
এ সফরে তার সঙ্গে থাকছেন চারটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। তারা হলেন—বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এবং এনসিপির আখতার হোসাইন।
জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার কার্যক্রম
২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। সেখানে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরবেন।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এবারই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ মহাসচিবের সভাপতিত্বে রোহিঙ্গা বিষয়ক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে আশ্রিত লাখো রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ সমাধানে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এ সফর এমন সময়ে হচ্ছে, যখন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা, নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন—এসব বিষয় সফরের মূল এজেন্ডায় থাকবে।
এর আগে বাংলাদেশের নেতারা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিলেও এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র, আর বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চারটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সফরসঙ্গী হওয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র তুলে ধরার কৌশল। অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করছেন, কেবলমাত্র কয়েকজন প্রতিনিধিকে সঙ্গে নেওয়া যথেষ্ট নয়; বরং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত ছিল।
বিএনপি ও জামায়াতের প্রতিনিধিদের সফরসঙ্গী করা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও আলোচনা চলছে। কেউ কেউ এটিকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন, আবার অন্য অংশ একে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন।
রোহিঙ্গা সংকটে বৈঠকের গুরুত্ব
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় দেশটির অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় চাপ তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আশা করছেন, জাতিসংঘের আলোচনায় নতুন কোনো উদ্যোগ আসতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সম্ভাব্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কে অবস্থানকালে জাতিসংঘ মহাসচিব, পাকিস্তান ও ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এসব বৈঠকে অর্থনীতি, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। ফলে এসব বৈঠক আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
নিরাপত্তা প্রস্তুতি
প্রধান উপদেষ্টার সফর চলাকালে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, নিউইয়র্ক পুলিশ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে এবং সফর নির্বিঘ্ন করার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর বাংলাদেশের জন্য শুধু কূটনৈতিক সুযোগই নয়, বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার একটি বড় পরীক্ষা। যদি প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন, তাহলে আসন্ন নির্বাচনের বৈধতা আরও দৃঢ় হবে। তবে সমালোচকরা মনে করেন, কেবল আন্তর্জাতিক মহল নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ঘিরে নানা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ, নির্বাচনী প্রস্তুতির বার্তা এবং দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে। এখন দেখার বিষয়—এই সফর কি দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে সহায়তা করবে, নাকি নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
এম আর এম – ১৩৮৪,Signalbd.com