ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সদর দফতর গুঁড়িয়ে দিল ইরান

ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের কিরিয়া এলাকায় অবস্থিত প্রতিরক্ষা সদর দফতর মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরান। বিশ্বের অন্যতম আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ভেঙে এই হামলা সফলভাবে চালিয়েছে তেহরান। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য টাইমস ও নিউইয়র্ক টাইমস যাচাই করা ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে।
প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক এই হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গতকাল শুক্রবার। ১৯ সেকেন্ডের এই ক্লিপে দেখা যায়, একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিয়ে সরাসরি রাজধানীর প্রতিরক্ষা সদর দফতরে আঘাত হানে। ভিডিওর পটভূমিতে দেখা যায় মার্গানিট টাওয়ার, যা ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (IDF) কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কৌশলগত ব্যর্থতা: আয়রন ডোম ভেঙে হামলা
আয়রন ডোমকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং কার্যকর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি স্বল্প পাল্লার রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সক্ষম। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনায় এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং লক্ষ্যভেদী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা আয়রন ডোমের সনাক্তকরণ ও বাধাদানের সক্ষমতা অতিক্রম করেছে।
মার্গানিট টাওয়ার, যেটি হামলার পেছনে দৃশ্যমান ছিল, সেই এলাকাটি কিরিয়া সামরিক ঘাঁটির অন্যতম প্রধান অংশ। এটি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত।
পটভূমি: ইসরায়েলের আগ্রাসনের পাল্টা জবাব
এই আক্রমণের আগে শুক্রবার সকালে ইসরায়েল ইরানের একাধিক সামরিক ঘাঁটি এবং পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রখ্যাত পরমাণুবিজ্ঞানীরা নিহত হন। তেহরান এই হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ হিসেবে উল্লেখ করে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের প্রতিক্রিয়াটিকে শুধু প্রতিশোধ বলেই নয়, বরং একটি কৌশলগত এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। এই হামলা শুধু ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতার ওপর আঘাত নয়, বরং গোটা বিশ্বে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার পরপরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়ই ইরানের এই পদক্ষেপকে ‘উস্কানিমূলক ও বিপজ্জনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। অপরদিকে রাশিয়া ও চীন এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে তারা পরিস্থিতি শান্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সংঘর্ষকে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছে। তুরস্ক এবং কাতার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এই হামলা চালিয়ে ইসরায়েলকে কৌশলগতভাবে চমকে দিয়েছে। আয়রন ডোমে আস্থা হারানো এখন ইসরায়েলের জন্য এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। এর ফলে দেশটির অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
ইসরায়েল এখন কঠোর সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির বিমানবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও আশঙ্কা
এই ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক হামলার ঘটনায় ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী তেল আবিবের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকেই রাজধানীর বাইরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইরানের অভ্যন্তরেও একই ধরনের আশঙ্কা বিরাজ করছে। দেশটির মানুষ এখন সম্ভাব্য ইসরায়েলি পাল্টা হামলার ভয়ে রাত্রিযাপন করছেন।
সম্ভাব্য পরিণতি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল এবং ইরান-রাশিয়া-চীন অক্ষের মধ্যে উত্তেজনা যদি আর বাড়ে, তাহলে তা গোটা বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই মুহূর্তে কূটনৈতিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি। জাতিসংঘ, ওআইসি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যস্থতা না হলে এই সংঘাত আরও জটিল ও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।