ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ বঙ্গোপসাগরে চোখ রাঙাচ্ছে, খুলনাসহ উপকূলে ঝুঁকি বাড়ছে

বঙ্গোপসাগরে নতুন করে তৈরি হতে যাচ্ছে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, যার সম্ভাব্য নাম ‘শক্তি’। আবহাওয়াবিদদের মতে, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এই ঝড় স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। সম্ভাব্য আঘাতের এলাকা হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় অঞ্চল—বিশেষ করে খুলনা, চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূল চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’: কী বলছে আবহাওয়া অফিস?
আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ তার সর্বশেষ বিশ্লেষণে জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-মধ্য অংশে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য অনুকূল। তিনি বলেন, “যেভাবে সাগরের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
রোববার (১১ মে) নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, আগামী ২৪ থেকে ২৬ মে’র মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। সম্ভাব্য আঘাতের পরিধি ভারতের ওড়িশা থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে খুলনা বিভাগ এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূল।
কীভাবে নাম হলো ‘শক্তি’?
ঘূর্ণিঝড়টির নাম ‘শক্তি’ শ্রীলঙ্কার প্রস্তাব অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আট দেশের অংশগ্রহণে গঠিত প্যানেল অনুযায়ী ঝড়ের নাম নির্ধারণ করা হয়। পূর্ব নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী এবার শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম পালা অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিডব্লিউওটির পূর্বাভাস: কীভাবে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়?
বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানিয়েছে, ১৬ থেকে ১৮ মে’র মধ্যে সাগরে একটি সার্কুলেশন বা ঘূর্ণন চক্র তৈরি হতে পারে। এটি ধীরে ধীরে লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ হয়ে পরিণত হবে পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড়ে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা এবং নিম্নচাপের ঘনত্ব—এই তিন উপাদান মিলেই ঘূর্ণিঝড় জন্ম নেয়। এই মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকায় ঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কী ক্ষতি হতে পারে?
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ যদি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসে, তবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে হতে পারে তীব্র ঝড়ো হাওয়া, ভারি বর্ষণ এবং ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। বিশেষ করে নদীবেষ্টিত এলাকা ও চরাঞ্চলে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে এ ঝড়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ঘূর্ণিঝড়টি যদি পূর্ণ শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানে, তাহলে ফসলের ক্ষতি, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
সরকারি প্রস্তুতি ও সতর্কতা
সরকার ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং সিভিল ডিফেন্স বাহিনীকে আগাম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে। জেলার প্রশাসকরা উপকূলীয় অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, মাইকিং করে প্রচারণা চালানো এবং স্থানীয় পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবক দলকে সক্রিয় করার কাজ শুরু করেছেন।
আবহাওয়া অধিদফতর এখনো চূড়ান্ত কোনো সতর্কতা জারি করেনি। তবে তাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি সতর্ক নজরে রাখা হচ্ছে এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় সতর্কতা জারি করা হবে।
মাছ ধরা ও নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে
সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা এবং যাত্রীবাহী ছোট নৌযানগুলোর ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ২০ মে’র পর থেকে গভীর সাগরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তখন নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।
স্থানীয়দের জন্য করণীয়
উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের এখন থেকেই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। নিচে স্থানীয়দের জন্য কিছু জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হলো:
- আবহাওয়ার নিয়মিত আপডেট শুনতে হবে।
- ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থান জেনে রাখতে হবে।
- প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন শুকনো খাবার, ওষুধ, ব্যাটারি, টর্চলাইট প্রস্তুত রাখতে হবে।
- মাছ ধরা ও সাগরে যাওয়া সম্পূর্ণরূপে এড়াতে হবে।
- শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আগাম সতর্কতা মানেই জীবন রক্ষা
ঘূর্ণিঝড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও আগাম সতর্কতা, পরিকল্পনা এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। ‘শক্তি’ এখনও পুরোপুরি সৃষ্টি হয়নি, তবে আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে, এটি হতে পারে একটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়।
তাই এই সময় যথাযথ প্রস্তুতি এবং সচেতনতা অবলম্বন করাই হবে সকলের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ।