টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় একটি অধ্যায় রচিত হলো বিশ্ব মিডিয়ার অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ‘টাইম ম্যাগাজিন’ প্রকাশিত ২০২৫ সালের ‘বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের’ তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিশ্ব নেতৃত্বের প্রেক্ষাপটে ‘নেতা’ ক্যাটাগরিতে এবার এই তালিকায় নাম উঠেছে ড. ইউনূসের। একই তালিকায় আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার, মেক্সিকোর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া সেইনবোম এবং প্রযুক্তি ও মহাকাশ উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। তাদের সবাই নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ প্রভাবিত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক আলোচনায় শীর্ষে রয়েছেন।
নেতৃত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ইউনূস
ড. ইউনূস কেবল একজন অর্থনীতিবিদ কিংবা ক্ষুদ্রঋণ তাত্ত্বিকই নন, বরং এখন তিনি বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক নবজাগরণের প্রতীক। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রোফাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি এবং প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন তার প্রতি অকুণ্ঠ প্রশংসা জানিয়েছেন।
হিলারি ক্লিনটন তার লেখায় উল্লেখ করেন, “গত বছর বাংলাদেশের ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হন। ঠিক সেই সময় জাতির প্রত্যাশা পূরণে নেতৃত্বের সংকটে এক চেনা মুখ এগিয়ে আসেন—নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।”
হিলারির মতে, ড. ইউনূস এই সংকটময় সময়ে কেবল অন্তর্বর্তী সরকারে নেতৃত্বই দেননি, বরং জাতির সামনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি স্বচ্ছ ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনচিত্র শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত তার ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিশ্বজুড়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই নারী।
হিলারি ক্লিনটন আরও স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমি প্রথম ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যখন তিনি ক্ষুদ্রঋণ মডেল যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসে প্রয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তৎকালীন গভর্নর বিল ক্লিনটন ও আমি তার এই প্রয়াসে সহযোগিতা করি। সেই থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমি তার কাজের ব্যাপক প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছি।”
এক জীবনে বহু পরিচয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনচিত্র নতুন প্রজন্মের জন্য আদর্শ। ক্ষুদ্রঋণের জনক হিসেবে তার অবদান শুধু অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে তার কাজ বিশ্বজুড়ে সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে জনপ্রিয় করেছে। ‘সামাজিক ব্যবসা’ তার একটি অনন্য সংজ্ঞা, যেখানে ব্যবসা মুনাফার জন্য নয়, বরং সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য পরিচালিত হয়।
বিশ্বের নানামুখী সামাজিক সংকটের প্রেক্ষিতে ড. ইউনূস এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মতে, “মানুষ কেবল মুনাফার জন্য কাজ করে না, মানুষের হৃদয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার ইচ্ছাও জন্মগত। এই ইচ্ছাকেই সামাজিক ব্যবসার ভিত্তি বানানো উচিত।”
নেতৃত্বের নতুন ভূমিকায় ড. ইউনূস
ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেন। তার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি নতুনভাবে আলোচনায় আসে।
তিনি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং মানবাধিকারের ওপর জোর দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইমেজও ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার নীতিনিষ্ঠ অবস্থান ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করছে।
টাইম ম্যাগাজিনের স্বীকৃতি
টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকা বিশ্বব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তি কোনো কাকতালীয় সম্মান নয়। তালিকায় উঠে আসা ব্যক্তিত্বরা তাদের সমাজ, দেশ কিংবা বিশ্বে গতানুগতিক চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে সমাজ পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রাখছেন।
ড. ইউনূসের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে, একজন অর্থনীতিবিদ হয়েও কিভাবে একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংস্কার আনয়ন সম্ভব। টাইম ম্যাগাজিন তার প্রোফাইলে উল্লেখ করেছে, “ইউনূস কেবলই একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ নন, তিনি এমন একজন নেতা যিনি স্বপ্ন দেখান এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করেন।”
বাংলাদেশের জন্য সম্মানের মুহূর্ত
ড. ইউনূসের এই অর্জন গোটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের। একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তার এ স্বীকৃতি প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের কণ্ঠ কতটা মূল্যবান হতে পারে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বের এই সম্মান অনেককেই নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ আরও সুসংহত হবে। বিশেষ করে তার ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার’ উদ্যোগ আগামীর বাংলাদেশ গঠনে বড় ভূমিকা রাখবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেও, তার নেতৃত্বের ইতিবাচক প্রভাব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন
হিলারি ক্লিনটন তার প্রোফাইলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বগুণের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন, “এখন ড. ইউনূস তার দেশের ডাকে আবারও সাড়া দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে নিপীড়নের ছায়া থেকে মুক্ত করতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন, জবাবদিহিতার দাবি জানাচ্ছেন এবং একটি ন্যায়বিচার ও মুক্ত সমাজের ভিত্তি স্থাপন করছেন।”
হিলারির এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, বিশ্ব রাজনীতিতে ড. ইউনূস কেবল বাংলাদেশেরই নয়, বরং একটি প্রগতিশীল, মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবেও গণ্য হচ্ছেন।
উপসংহার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল সংযোজন। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে তার নেতৃত্ব কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্ব সমাজের জন্যও এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠছে। ‘নেতৃত্ব’ যে কেবল ক্ষমতা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সমন্বিত প্রকাশ, তার জীবনের এই অধ্যায় তারই উজ্জ্বল প্রমাণ।