রাশিয়ার ক্রেতাদের কাছে ১৪টি পোশাক কারখানার ৭৬ লাখ ডলার আটকা: বিকেএমইএ

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাতে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। রাশিয়ার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশের ১৪টি পোশাক কারখানার প্রায় ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার আটকা পড়েছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানির পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ১৪টি কারখানা তাদের পাওনা অর্থ আদায় করতে পারছে না। লেনদেন–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে রাশিয়ার ক্রেতারা এই অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।’
লেনদেনের জটিলতা ও সমাধানের প্রস্তাব
মোহাম্মদ হাতেম জানান, প্রাথমিকভাবে চীনের ব্যাংকের মাধ্যমে কিছু অর্থ আদায় করা গেলেও পরবর্তীতে তা সম্ভব হয়নি। এই সমস্যা সমাধানে তিনি একটি উদ্ভাবনী প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাশিয়ার পাওনার সঙ্গে এই ১৪টি কারখানার আটকে থাকা অর্থ সমন্বয় বা বিনিময় ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।’ এই প্রস্তাবের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের জটিলতা কমানো সম্ভব হবে বলে তিন’i আশাবাদী।
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের বিধিনিষেধ এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।’ তিনি সরকারের কাছে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান, যাতে কারখানাগুলো তাদের ন্যায্য পাওনা ফেরত পায়।
বিকেএমইএ নির্বাচন ও ইশতেহার ঘোষণা
এই তথ্য প্রকাশিত হয় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিকেএমইএর ২০২৫-২৭ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন উপলক্ষে প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্সের ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ হাতেম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাশিয়ার ক্রেতাদের কাছে আটকে থাকা অর্থের বিষয়টি তুলে ধরেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদসহ প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্সের অন্যান্য প্রার্থীরা।
আগামী শনিবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে বিকেএমইএর নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নির্বাচনে মোট ৫৮২ জন ভোটার অংশ নেবেন। ৩৫টি পদের বিপরীতে প্রার্থী রয়েছেন ৩৮ জন, যার মধ্যে প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্সের প্রার্থীই ৩৫ জন।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রভাব
অনুষ্ঠানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এর জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানিতে এখনই কোনো বড় সমস্যা হবে না। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকবে, যা সীমান্ত বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের জন্য তুলা, সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করা হয়। যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে এই কাঁচামালের দাম বাড়তে পারে, যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।’
প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্সের ইশতেহার
প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্স তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ১৫ দফা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হলো আমদানি-রপ্তানি সহজীকরণের জন্য কাস্টমস–সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা। এ লক্ষ্যে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও বাস্তবধর্মী নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে।
এ ছাড়া, ইশতেহারে এইচএস কোডের জটিলতা নিরসন, ভ্যাট–সংক্রান্ত হয়রানি দূরীকরণ, ব্যাংক খাতের জটিলতা সমাধান এবং ঢাকায় বিকেএমইএর নিজস্ব ভবন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হলে পোশাক রপ্তানি খাতে নতুন গতি সঞ্চার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক রপ্তানি খাত একটি প্রধান চালিকাশক্তি। এই খাত থেকে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এই খাতকে। রাশিয়ার ক্রেতাদের কাছে আটকে থাকা অর্থ এই চ্যালেঞ্জের একটি উদাহরণ। এ ছাড়া, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন এবং অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এই খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো এই খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা। এজন্য আমরা সরকার, ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছি।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।
সরকারের ভূমিকা ও প্রত্যাশা
বিকেএমইএ সভাপতি সরকারের কাছে এই খাতের জন্য আরও নীতিগত সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সরকার আমাদের পাশে থাকুক। রাশিয়ার ক্রেতাদের কাছে আটকে থাকা অর্থ উদ্ধারে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’ এ ছাড়া, তিনি কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং ভ্যাট-ট্যাক্স সংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
উপসংহার
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাত বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাশিয়ার ক্রেতাদের কাছে ৭৬ লাখ ডলার আটকে থাকার ঘটনা এই খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা। তবে, বিকেএমইএর নেতৃত্বে নতুন নির্বাচনী ইশতেহার এবং প্রগ্রেসিভ নিট অ্যালায়েন্সের প্রতিশ্রুতিগুলো এই খাতে নতুন আশার সঞ্চার করছে। সরকার, ব্যাংক এবং শিল্প সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।