বিশ্ব

কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২০ জন নিহত হওয়ার শঙ্কা

কাশ্মীরের পর্যটননির্ভর অঞ্চলে আজ মঙ্গলবার বড় ধরনের সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। জম্মু-কাশ্মীরের অনিন্দ্যসুন্দর পর্যটনকেন্দ্র পহেলগামের বৈসারন উপত্যকায় তিনজন সশস্ত্র জঙ্গি পর্যটকদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এই ঘটনায় অন্তত ২০ জনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ও বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ঘটনার পরপরই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। এলাকা ঘিরে ফেলে চালানো হচ্ছে যৌথ অভিযান। ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

হঠাৎ হামলায় স্তব্ধ শান্ত উপত্যকা

পহেলগামের বৈসারন উপত্যকাটি মূলত শান্তিপূর্ণ ও নিরিবিলি পরিবেশের জন্য পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এই রিসোর্টে পৌঁছানোর জন্য পথচারী কিংবা ঘোড়ায় চড়ে যেতে হয়, যার ফলে এটি অনেকটাই বিচ্ছিন্ন এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে অবস্থিত। ঠিক এই সুযোগটিই নিয়েছে জঙ্গিরা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সশস্ত্র তিন ব্যক্তি আচমকাই পর্যটকদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। হামলার সময় রিসোর্টে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের বেশি পর্যটক ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলে পালিয়ে যান। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

হামলার দায় স্বীকার ‘কাশ্মীর রেসিস্ট্যান্স’ গোষ্ঠীর

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘কাশ্মীর রেসিস্ট্যান্স’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বার্তা দিয়ে গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, “ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ চলবে।” তবে বার্তাটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।

এই গোষ্ঠীটির সঙ্গে আগে কখনো বড় ধরনের সহিংসতার সংশ্লিষ্টতা ছিল না, যার ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন গোষ্ঠীটির কর্মকাণ্ড, উদ্দেশ্য ও আন্তর্জাতিক সংযোগ খতিয়ে দেখছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরত

ঘটনার খবর পাওয়ার পর দিল্লিতে জরুরি বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, গোয়েন্দা প্রধান তপন ডেকা এবং স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ মোহন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে অংশ নেন সিআরপিএফ প্রধান জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিং, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিচালক নলিন প্রভাত এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৈঠক থেকেই অমিত শাহ কথা বলেন জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার সঙ্গে।

তাদের নির্দেশে কাশ্মীর উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, চলছে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং ড্রোনের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলগুলো নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

পর্যটন খাতে ভয়াবহ প্রভাবের শঙ্কা

এই হামলার প্রভাব কাশ্মীরের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক বছর পর কাশ্মীরে পর্যটনের গতি ফিরছিল। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও দীর্ঘ সময় ধরে পর্যটকদের নিশানা করেনি, বরং তাদের হামলা সাধারণত নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি স্থাপনাগুলোর ওপর সীমাবদ্ধ ছিল।

তবে গত বছর মে মাসে পহেলগামেই দুজন পর্যটক হামলার শিকার হন, যদিও তখন সরকার একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু এবার এই হামলা কৌশলগত বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

কাশ্মীরের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন হামলার ফলে পর্যটকরা কাশ্মীরে ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে পারেন, যার ফলে হোটেল, পরিবহন, খাবার ও হস্তশিল্প খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে দাবি করে আসছিল। শান্তিপূর্ণ ভোট, পর্যটনের উত্থান এবং সন্ত্রাসবাদে হ্রাস—এই তিনটি উপাদানকে সামনে রেখে তারা উপত্যকার উন্নয়নের প্রচার করছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিক বক্তৃতায় কাশ্মীরকে ‘নতুন যুগে প্রবেশ করা অঞ্চল’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

কিন্তু মঙ্গলবারের হামলা সেই দাবির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা প্রমাণ করেছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, বরং তারা নতুন কৌশল ও লক্ষ্য নির্ধারণ করছে।

মানবিক দিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থ

হামলায় আহতদের মধ্যে কয়েকজন নারী ও শিশু রয়েছেন। তাদের হেলিকপ্টারে করে শ্রীনগর এবং অনন্তনাগের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা সংকটজনক। হেলিকপ্টার পরিষেবার পাশাপাশি জরুরি রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কাশ্মীরের স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের আপাতত পহেলগামমুখী না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। হোটেল ও গেস্টহাউসগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে এবং পর্যটকদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই হামলার পর জাতিসংঘের মহাসচিব এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান সরকারও এক বিবৃতি দিয়ে হামলার নিন্দা জানিয়েছে, যদিও ভারত বিষয়টিকে ‘দ্বিচারিতা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক দপ্তরগুলো হামলায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে এবং কাশ্মীরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে।

উপসংহার

কাশ্মীর উপত্যকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর এই ধরনের হামলা শুধু স্থানীয় নিরাপত্তা নয়, গোটা উপমহাদেশের স্থিতিশীলতাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। পহেলগামের মতো পর্যটনকেন্দ্রের ওপর হামলা কেবল নিরীহ প্রাণহানিই ঘটায় না, এটি কাশ্মীরের অর্থনীতি ও সামাজিক মনস্তত্ত্বেও গভীর প্রভাব ফেলে।

এই ঘটনায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কাশ্মীর সংকটের অবসান এখনও হয়নি এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের হামলা প্রতিরোধে আরও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button