বিশ্ব

৪৩ বছরেও চালু হয়নি পরিমাপের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি

আজ বিশ্ব পরিমাপ দিবস। অথচ বাস্তবতার চিত্র বলছে, ৪৩ বছর পেরিয়েও বাংলাদেশে ওজন ও পরিমাপের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক পরিমাপ সংক্রান্ত জটিলতায় আটকা পড়েছে ভারতের আম রপ্তানির অন্তত ১৫টি চালান, যার ফলে প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়েছেন রপ্তানিকারকেরা।

বাংলাদেশে এখনো প্রথাগত পদ্ধতির ব্যবহার, ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত

১৯৮২ সালে বাংলাদেশে ওজন ও পরিমাপে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি (সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল—SI Units) চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এতে তরল মাপে লিটার, কঠিন বস্তুর ওজনে কেজি-গ্রাম এবং দৈর্ঘ্যে মিটার ব্যবহারের কথা বলা হয়। কিন্তু ৪৩ বছর পরও রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো গজ, সের, মণ, ভরি-তোলার মতো প্রথাগত পদ্ধতিরই আধিপত্য।

বিশেষ করে পুরান ঢাকার ইসলামপুর, মৌলভীবাজার, শাঁখারীবাজার এবং তাঁতিবাজার এলাকায় এখনো কাপড় বিক্রি হচ্ছে গজে, সোনা বিক্রি হচ্ছে ভরিতে, এমনকি তেল বিক্রি হচ্ছে মণ ধরে। ভোক্তারা প্রায়ই এই জটিল এবং অননুমোদিত মাপে প্রতারিত হচ্ছেন।

এই বাস্তবতায় ওজন ও পরিমাপ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। যদিও সংস্থাটি বলছে, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়, তবে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন—জোর করে পরিমাপ পদ্ধতি চাপিয়ে দিলে তা কার্যকর হয় না।

আন্তর্জাতিক মাপে ভুলেই আমেরিকায় ঢুকতে পারল না ভারতের আম, লোকসান ৫ লাখ ডলার

বাংলাদেশের মতো আন্তর্জাতিক পরিমাপ ব্যবস্থার ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে ভারতকেও। সম্প্রতি ভারতের মুম্বাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আমের ১৫টি চালান মার্কিন বিমানবন্দরগুলোতে আটকা পড়েছে। মার্কিন কৃষি বিভাগ USDA অভিযোগ করেছে, রপ্তানিকৃত আমগুলোর জন্য ইস্যু করা PPO 203 ফর্ম বা বিকিরণ সনদে ভুল ছিল।

ফলে আমগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে রপ্তানিকারকেরা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার (৪.৫ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে ই-রেডিয়েশন (বিকিরণ) প্রক্রিয়ার নথিপত্রে ভুলের কারণে, যা আন্তর্জাতিক পরিমাপ ও সনদ পদ্ধতির দুর্বল বাস্তবায়নের নিদর্শন।

রপ্তানিকারকেরা দাবি করেছেন, মুম্বাইয়ে USDA অনুমোদিত একটি কেন্দ্রে সঠিকভাবে বিকিরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় এবং USDA-এর কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ফর্ম ইস্যু করা হয়েছিল। তারপরও ফর্ম সংক্রান্ত ‘বিষয়গত অসঙ্গতির’ কারণে চালান আটকে দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা ধ্বংস করতে হয়।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনার মাঝেই এ বিপর্যয়

ঘটনাটি এমন সময় ঘটল, যখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ভারত প্রায় শূন্য শুল্কে চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই চুক্তির আওতায় ভারত চায়—বস্ত্র, রত্ন, চামড়া, মাছ, তেলবীজ, আঙুর ও কলার মতো শ্রমঘন খাতে শুল্ক হ্রাস। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে—যানবাহন, দুগ্ধজাত পণ্য, আপেল ও বাদামের মতো পণ্যে ভারতের শুল্ক কমানো হোক।

এ অবস্থায় পরিমাপ সংক্রান্ত এমন জটিলতা ভারতীয় রপ্তানির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

বিশ্ব পরিমাপ দিবস: সবার জন্য পরিমাপ – বাস্তবে কতটা প্রাসঙ্গিক?

এবারের বিশ্ব পরিমাপ দিবসের প্রতিপাদ্য: ‘সর্বকালেই পরিমাপ সবার জন্য’ (Measurements for Everyone, Everywhere, Always)। এই স্লোগান সামনে রেখেই বাংলাদেশে বিএসটিআই নানা প্রচারণা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে—যেমন আলোচনা সভা, রেডিও অনুষ্ঠান, এসএমএস প্রচারণা, ব্যানার ও ফেস্টুন লাগানো ইত্যাদি।

এ উপলক্ষে আজ সকালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম)-এ এক আলোচনা সভাও আয়োজন করা হয়েছে।

তবে বাস্তব চিত্র বলছে, যতক্ষণ না বাস্তবায়ন কার্যকর হচ্ছে, ততক্ষণ এসব আয়োজন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য রপ্তানিকারকদেরও আন্তর্জাতিক পরিমাপ ও নথিপত্র ব্যবস্থায় আরও বেশি দক্ষতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে—নইলে এমন বিপর্যয় আরও ঘটতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button