বাংলাদেশ

উৎসব, ঐতিহ্য ও প্রতিবাদের মেলবন্ধনে শেষ হলো নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে বরণ করে নিতে জাতীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ঢাবির চারুকলা অনুষদ থেকে বের হওয়া বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা এবারও রঙিন, বর্ণাঢ্য ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে শেষ হয়েছে। রঙ, সংস্কৃতি, প্রতিবাদ ও সাম্যের বার্তা নিয়ে আয়োজিত এই শোভাযাত্রাটি হয়ে ওঠে জাতির ঐক্যের এক প্রতিচ্ছবি।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের প্রাঙ্গণ থেকেই শুরু হয় এই ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা। সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এটি। এরপর শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা ঘুরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আবার চারুকলা অনুষদের প্রাঙ্গণে এসে শোভাযাত্রাটি শেষ হয়।

শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য: ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’

চলতি বছরের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’, যা শুধু সাংস্কৃতিক উদযাপনই নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে। এই প্রতিপাদ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আয়োজকরা একটি প্রতিবাদী বক্তব্যও রাখতে চেয়েছেন— যা বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় তাৎপর্যপূর্ণ।

এই প্রতিপাদ্য যেন শোভাযাত্রার প্রতিটি পর্বে, প্রতিকৃতিতে ও প্রতিমূর্তিতে নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। শুধু আনন্দ আর রঙের মাধ্যমে নয়, বরং বার্তা ও ব্যঞ্জনায়ও শোভাযাত্রাটি ছিল অত্যন্ত অর্থবহ।

নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

বরাবরের মতো এবারও শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় উপাচার্য বলেন,
“নববর্ষ শুধু একটি উৎসব নয়, এটি একটি প্রতিরোধ, একটি প্রতিবাদ এবং জাতি গঠনের অনুপ্রেরণা। শোভাযাত্রা আমাদের ঐক্য, সৌহার্দ্য ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক।”

মুখ্য মোটিফ: ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি

এবারের শোভাযাত্রায় সবচেয়ে আলোচিত ও নজরকাড়া মোটিফ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। কাগজ, কাঠ ও ককশিট দিয়ে তৈরি এই মুখাবয়বটি ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করানো হয়। শোভাযাত্রার একপর্যায়ে পুরোনো মুখাবয়বটি প্রতীকীভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়, এরপর নতুন করে তৈরি করা হয় আরেকটি মুখাবয়ব।

এই প্রতীকী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয়োজকরা বোঝাতে চেয়েছেন— ফ্যাসিবাদকে বারবার প্রতিহত করতে হবে, বারবার তার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। এটি শুধু একটি শৈল্পিক উপস্থাপনাই নয়, বরং সমাজে সচেতনতার বার্তা দেয়।

স্মরণে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ: ‘পানি লাগবে পানি’

শোভাযাত্রায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল গত বছর জুলাই আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ-এর স্মরণে তৈরি মোটিফ— ‘পানি লাগবে পানি’। এটি ছিল এক গভীর বার্তা— রাজপথে পানির দাবিতে জীবন দেওয়া একজন তরুণকে স্মরণ এবং তার দাবি ও স্বপ্নকে বহন করার একটি উপায়।

শুধু উৎসব নয়, শোভাযাত্রা যেন স্মরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেও পরিণত হয়, তা-ই এই মোটিফটি প্রতিষ্ঠা করে।

বর্ণিল প্রতিকৃতি ও মুখোশ: শিল্প আর সংস্কৃতির উদযাপন

এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় ছিল পায়রা, মাছ, বাঘ, তরমুজ, পেঁচা, মুখোশসহ নানা রকম প্রতিকৃতি। প্রত্যেকটি প্রতিকৃতি আলাদা বার্তা বহন করে— যেমন পায়রা শান্তির প্রতীক, বাঘ সাহসের, তরমুজ ঋতু বৈচিত্র্যের। শিল্পকর্মগুলোতে ব্যবহৃত রঙ ও কাঠামো ছিল চোখ জুড়ানো ও শিল্পনির্ভর।

চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ হাতে বানানো মুখোশ, কাঠের মূর্তি, আলপনা এবং বিশালাকৃতির প্রতিমূর্তিগুলোর মধ্যে ফুটে উঠেছে বাঙালির লোকজ ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অনন্য এক মেলবন্ধন।

২৮টি জাতিগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ

এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের ২৮টি জাতিগোষ্ঠী। প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরেন। এর ফলে শোভাযাত্রাটি হয়ে ওঠে একটি বহুজাতিক সংস্কৃতির সম্মিলন

এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিরাও অংশগ্রহণ করেন এই বর্ষবরণ আয়োজনে, যারা বাংলার এই উৎসব দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।

নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

শোভাযাত্রা ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও আশপাশে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা। নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), র‍্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন।

এছাড়াও, পুরো এলাকায় ছিল নজরদারি ক্যামেরা, মেটাল ডিটেক্টর ও চেকপোস্ট। আগত দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরের রাস্তাগুলোয় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করা হয়।

সংস্কৃতি, প্রতিবাদ আর সমানাধিকারের বার্তা

শুধু উৎসব নয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে সংস্কৃতি, প্রতিবাদ ও সমানাধিকারের বার্তা। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সংস্কৃতির ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা আবারও প্রমাণ করে দিলো এই আয়োজন।

শোভাযাত্রার প্রতিটি অংশ যেন নিজস্ব ভাষায় বলেছে—

  • “আমরা একসাথে এগিয়ে যাবো”
  • “ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করবো”
  • “নববর্ষে নতুন আশা নিয়ে বাঁচবো”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন

নববর্ষের শোভাযাত্রার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। অনেকেই নিজের মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি ও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে।

শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাযাত্রার খবর স্থান করে নিয়েছে, যা বাংলাদেশকে সংস্কৃতির দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে।

নববর্ষে ঐতিহ্য ও প্রতিবাদের মিলনমেলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে বর্ষবরণ শোভাযাত্রা কেবল একটি বর্ণিল উৎসব নয়, এটি একটি প্রতিবাদী মঞ্চ, একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং একটি ঐক্যের বার্তা।

‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ স্লোগান নিয়ে এই শোভাযাত্রা প্রমাণ করে—বাংলা নববর্ষ কেবল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের দিন নয়, এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তার বাহক। এমন একটি শোভাযাত্রা কেবল আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশকও।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button