আঞ্চলিক

নদীতে ধরা পড়ল এক মণ ওজনের শুশুক

পদ্মা নদীতে ধরা পড়ল প্রায় ৪০ কেজি ওজনের এক বিপন্ন শুশুক (বাংলাদেশি ডলফিন)। নদীর তীরে জেলেদের জালে ধরা পড়া এই বিরল জলজ প্রাণীটি স্থানীয় এক আড়তে মাত্র ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ঘটনা মঙ্গলবার বিকেলে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় ঘটেছে।

পদ্মার জলেই ধরা পড়ল বিরল শুশুক

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা নদীতে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ধরা পড়েছে এক বিরল এবং বিপন্ন শুশুক। স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়ে এক জেলে বড় ধরনের ঝাঁকি অনুভব করেন। পরে যখন জাল টেনে নৌকায় তুলেন, তখন দেখতে পান, সেটা কোনো বড় মাছ নয়, বরং এক বিশাল শুশুক।

পাবনার বাল্লা এলাকার জেলে বৈরাগী হালদার বলেন, “আমরা কয়েকজন মিলে মাছ শিকারে নেমেছিলাম। ঝাঁকি পেয়েই ভাবলাম বড় কোনো মাছ আটকা পড়েছে। কিন্তু জাল তুলতেই দেখতে পেলাম, বড় এক শুশুক ধরা পড়েছে। আমরা জানি, শুশুক মানুষের খাদ্য নয়, তবে শুশুকের তেল দিয়ে মাছ ধরার বড়শি তৈরি করেন অনেক জেলে।”

দৌলতদিয়া ঘাটে বিক্রি মাত্র ৭০০ টাকায়

শুশুকটি ধরা পড়ার পর তা বিক্রির জন্য নৌকায় তুলে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের স্থানীয় এক আড়তদার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আড়তদার জাহিদুল ইসলাম জানান, দীর্ঘক্ষণ বিক্রি হওয়ায় অনেকেই দাম কম দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় এক মৎস্যজীবী ৭০০ টাকায় এটি কিনে নেন। এরপর রাতে শুশুকটি বিক্রি হয়ে যায় এবং জেলেরা মানিকগঞ্জের বাল্লায় ফিরে যায়।

শুশুক: বাংলাদেশের নদীতে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতি

শুশুক বা ইন্দো-প্যাসিফিক নদী ডলফিন বাংলাদেশে অন্যতম বিরল ও বিপন্ন জলজ প্রাণী। সাধারণত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও কুয়াকাটা অঞ্চলের নদী ও জলাশয়ে শুশুকের বিচরণ দেখা যায়। কিন্তু বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী শুশুক শিকার, পরিবহন এবং বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, “শুশুক সাধারণত মানুষের চোখে পড়ে না। বর্ষাকালে নদীর পানি ঘোলা হলে মাছের সঙ্গে শুশুকের উপস্থিতি কিছুটা লক্ষ্য করা যায়। আমরা শুশুক সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে কেউ তাদের শিকার করতে না পারে।”

শুশুক শিকারের প্রভাব ও পরিবেশগত গুরুত্ব

শুশুক বাংলাদেশের মিঠা জলজ পরিবেশের সুস্থতা এবং বাস্তুসংস্থানের ইঙ্গিতক। তারা নদীর খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, মাছের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তুসংস্থান সুরক্ষায় অবদান রাখে। শুশুকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নদীর জলবায়ু ও প্রাণীজগতের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে শুশুকের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, যার মূল কারণ বেদম শিকার, নদী দূষণ, অবৈধ জাল ব্যবহার এবং বাস্তুসংস্থানের ধ্বংস। এর ফলে শুশুককে সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুশুকের শিকার কেন নিষিদ্ধ?

বিপন্ন প্রজাতির শুশুকের শিকার আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে আছে তার পরিবেশগত ও প্রজাতিগত গুরুত্ব। শুশুক শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বব্যাপী জলজ পরিবেশের জন্য মূল্যবান প্রাণী। তাই এর শিকার ও অবৈধ ব্যবসা রোধে কঠোর আইন রয়েছে।

সরকার ও বিভিন্ন পরিবেশ সংস্থা শুশুক সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত অভিযান চালায় এবং স্থানীয় মানুষদের সচেতন করে। তবে এ ধরনের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইন প্রয়োগে আরও জোর দিতে হবে।

স্থানীয়দের কথা ও মাছ শিকারের বাস্তবতা

জেলেদের ভাষায়, শুশুকের তেল দিয়ে বড়শি বানানো হয়, যা দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। যদিও শুশুক মানুষের খাদ্য নয়, তবে এই বিপন্ন প্রাণীর উপর নির্ভরতা পরিবেশ ও প্রজাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিপজ্জনক। স্থানীয় জেলেরা জানায়, বৈরী আবহাওয়ার মাঝে নদীতে মাছ শিকার করতে নেমেই এই শুশুক ধরা পড়েছে।

পদ্মার মতো বড় নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা জরুরি

পদ্মা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নদী। এই নদীতে মাছ, জলজ প্রাণী ও বিশেষ করে বিপন্ন শুশুকের বসবাস জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী দূষণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও অবৈধ শিকার এই জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও নদীর পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ, পরিবেশবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত কাজ প্রয়োজন।

শুশুক রক্ষা: পদক্ষেপ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা

  • সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় মানুষ, জেলে ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে শুশুক সংরক্ষণ ও আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  • আইন প্রয়োগ: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, শিকার ও অবৈধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
  • পরিবেশ সংরক্ষণ: নদীর পানির গুণগত মান রক্ষা করা, দূষণ কমানো এবং বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণে কাজ করা।
  • গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ: শুশুকের সংখ্যা ও আচরণ নিয়ে গবেষণা করা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো।

পদ্মা নদীতে ধরা পড়া এক মণ ওজনের শুশুক বিক্রি হওয়া একটি উদ্বেগজনক ঘটনা। এটি শুধু স্থানীয় জেলেদের জীবিকার সংকট নয়, বরং আমাদের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এক বড় সংকেত। এই বিপন্ন প্রাণীর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া শুশুক ও এর মতো অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হবে।

শুশুকের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আমাদের সকলের দায়িত্ব। নদী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে আগামী প্রজন্মকে একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।

 MAH – 12023, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button