পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৭০০, লাখো মানুষ গৃহহীন

পাকিস্তান ভয়াবহ বন্যার করালগ্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলতি মৌসুমের অতিবৃষ্টি ও আকস্মিক পাহাড়ি ঢলের কারণে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় ও প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ২৬ জনের মৃত্যু হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
বন্যায় শুধু প্রাণহানি নয়, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছে পুরো দেশজুড়ে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা—সব কিছু ভেঙে পড়েছে পানির তোড়ে। প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং আরও লাখো মানুষ এখনো গৃহহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
কোথায় কী ঘটছে?
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (PDMA) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশেই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখানে অন্তত ২২২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা গেছে। এছাড়া বুনের জেলার অনেক গ্রাম পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাতে আকস্মিকভাবে নেমে আসা বন্যার ঢলে একাধিক গ্রাম পানির নিচে চলে যায়। উদ্ধারকর্মীরা এখনও সেখানে নিখোঁজ মানুষের খোঁজ চালাচ্ছেন।
- বুনের জেলা: সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি—২২২ জন।
- সোয়াবি, নোশেরা, মার্দান ও পেশোয়ার: ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে অন্তত ২৬ জন নিহত।
- ৭৮০টির বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে ৩৪৯টি পুরোপুরি ধ্বংস।
কবে শুরু হলো এই ভয়াবহ পরিস্থিতি?
পাকিস্তানে চলতি বছরের বর্ষাকাল শুরু হয় ২৬ জুন ২০২৫ থেকে। শুরুতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। খাইবার পাখতুনখাওয়া, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে টানা বৃষ্টিতে নদী-নালা উপচে পড়ে। গত সপ্তাহে ঘটে মেঘ বিস্ফোরণের ঘটনা, যা আকস্মিক বন্যার সূত্রপাত ঘটায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রাম, রাস্তা, ফসলি জমি সব কিছু ভেসে যায়।
আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবার্তা
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানে আগামী ২১ আগস্ট পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে নদীর পাড়, পাহাড়ি ঢালের কাছে এবং নীচু এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানবিক বিপর্যয়: গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত মানুষ
শুধু প্রাণহানিই নয়, পাকিস্তানে এখন মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।
- বন্যায় লাখো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
- হাজারো পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছে।
- গবাদিপশু ও ফসল নষ্ট হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
- পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
দেশটির তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তাতার জানিয়েছেন, প্রায় এক হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, যাদের অনেকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত।
অবকাঠামোগত ক্ষতি
বন্যায় ধসে গেছে বহু সেতু, ভেসে গেছে রাস্তাঘাট। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন
পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলের কাছে জরুরি সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। জাতিসংঘ, রেডক্রসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এত বড় বিপর্যয় মোকাবিলায় এককভাবে পাকিস্তানের পক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের এই দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যা, ভূমিধস, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তানের এই ভয়াবহ বন্যা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও সতর্কবার্তা। কারণ একই মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকেও প্রভাবিত করছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
পাকিস্তানে ২০২৫ সালের এই বন্যা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত। প্রাণহানি, অবকাঠামোগত ধ্বংস আর মানবিক সংকটের কারণে দেশটি এখন চরম দুঃসময় পার করছে। আগামী কয়েকদিন ভারী বৃষ্টি চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেই প্রস্তুত থাকতে হবে।
MAH – 12414 , Signalbd.com