বানিজ্য

রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৩ টাকা

দেশের অর্থনীতিতে যখন মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে, ঠিক সেই সময়ে দেশের স্বর্ণের বাজার আবারও নতুন রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সর্বশেষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশের বাজারে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি ২ হাজার ৬২৪ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মূল্য। আগামীকাল রবিবার (২০ এপ্রিল) থেকে এই নতুন মূল্য কার্যকর হবে।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের স্থানীয় বাজারেও তেজাবি স্বর্ণের দাম বেড়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই স্বর্ণের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির পেছনের কারণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা এবং সরবরাহের তারতম্য, ডলারের দামের ওঠানামা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা স্বর্ণের দামের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যখন বাড়ে, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের প্রতি বেশি আগ্রহী হন। এরই ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে বাংলাদেশের বাজারও তার প্রভাব অনুভব করে।

বাংলাদেশের স্বর্ণবাজারও এই বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে আলাদা নয়। স্থানীয়ভাবে তেজাবি স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে, স্বর্ণের গহনার মূল্যও স্বাভাবিকভাবেই সমন্বয় করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে বাজুস।

নতুন মূল্য তালিকা

বাজুসের ঘোষণায় ২২ ক্যারেট, ২১ ক্যারেট, ১৮ ক্যারেট এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের জন্য নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • ২২ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ২ হাজার ৬২৪ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৩ টাকা।
  • ২১ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ২ হাজার ৫০৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ২০৫ টাকা।
  • ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ২ হাজার ১৩৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০৯ টাকা।
  • সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ: প্রতি ভরি ১ হাজার ৮৩২ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারিত হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৯১ টাকা।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য যে, এর আগে গত বুধবারও স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি মূল্য ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯ টাকা, যা তারও আগে ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকা। এই ধারাবাহিক দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে স্বর্ণ ক্রয়ের আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলেও জানা গেছে।

ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া ও বাজারের পরিস্থিতি

দেশে স্বর্ণ মূলত বিয়ে-শাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রতি বছর ঈদ, পূজা এবং বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণের গহনার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের জন্য স্বর্ণ ক্রয় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর নিউমার্কেটের একাধিক জুয়েলারি দোকানের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দাম বাড়ার কারণে অনেক ক্রেতাই পুরনো গহনা বিক্রির পাশাপাশি অল্প পরিমাণ নতুন স্বর্ণ কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে দাম হঠাৎ করে এত বেশি বেড়ে যাওয়ায় নতুন ক্রেতাদের সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে।

ঢাকার মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন,
“বছর দুয়েক ধরে গহনা কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রতি মাসেই দাম বাড়ছে। এখন যে দামে উঠেছে, তাতে গহনা কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”

অন্যদিকে, জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প থাকে না।

অর্থনীতিতে স্বর্ণের গুরুত্ব ও বাজার বিশ্লেষণ

স্বর্ণকে দীর্ঘদিন ধরেই মূল্য সংরক্ষণকারী নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা কিংবা মুদ্রাস্ফীতির সময় স্বর্ণের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডলারের বিনিময় হার বাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং আমদানি নির্ভর এই বাজারে বিশ্ববাজারের পরিবর্তন স্বর্ণের দামে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপের কারণে ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে।

ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস

বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক মন্দা ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে। পাশাপাশি, দেশীয় অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক লেনদেনের চাপ বাড়লে এই প্রবণতা স্থায়ী হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. শামীম আহমেদ বলেন,
“স্বর্ণের বাজার শুধু দেশীয় পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে না। বৈশ্বিক অস্থিরতা ও ডলারের দামের তারতম্য মূল কারণ। এই ধারা চলতে থাকলে স্বর্ণের দাম আরও কিছুদিন বাড়তে পারে।”

বাজুসের পরামর্শ

বাজুসের পক্ষ থেকে ক্রেতাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, স্বর্ণ ক্রয়ের সময় অবশ্যই স্বীকৃত ও লাইসেন্সধারী জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মান যাচাইয়ের জন্য স্বর্ণে খোদাই করা ক্যারেট চিহ্ন ও বিক্রয় রশিদ ভালোভাবে দেখে নিতে হবে।

উপসংহার

দেশের স্বর্ণের বাজারে এই ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। বিয়ে, উৎসবসহ বিভিন্ন উপলক্ষে স্বর্ণের গহনা কেনার পরিকল্পনা অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলারের বিনিময় হার এবং তেজাবি স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাবই এই ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ।

দেশের স্বর্ণবাজারে দামের এই উত্থান- পতন স্বাভাবিক হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারের এই প্রবণতা সামনের দিনগুলোতে স্বর্ণ ক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button