আগামী বাজেট হবে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা: সংকট মোকাবিলায় কমানো হচ্ছে ব্যয়

বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ বাজেট আকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ধারাবাহিকভাবে বাজেটের আকার বাড়ানো হলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এবার সেই ধারার পরিবর্তন ঘটছে।
অর্থনৈতিক সংকট, রাজস্ব ঘাটতি, মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে এবার বাজেট কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থ, মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার–সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
কেন বাজেট কমছে?
বৈঠক সূত্র জানায়, সরকারের রাজস্ব আয়ের গতি আশানুরূপ নয়। শুল্ক ও কর আদায় প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়েনি, অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের ঋণ পরিশোধেও ব্যয় বাড়ছে। এসব কারণেই বাজেট সংকুচিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বর্তমান অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যেখানে রাজস্ব ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়, তবে তা হালনাগাদ করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ২১ শতাংশ কম।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেট কাঠামো
আগামী বাজেটে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দ ধরা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিগত বছরের মতো বড় নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে না। চলমান বড় প্রকল্পগুলোর জন্যই বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
বাজেটের প্রাধান্য পাবে যেসব খাত:
- স্বাস্থ্য
- শিক্ষা
- তথ্যপ্রযুক্তি
- সামাজিক নিরাপত্তা
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি
- গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধাভোগীদের সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় করা এবং কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা জনগণের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এজন্য বাজেটে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য নানাবিধ পদক্ষেপের কথা উঠে আসতে পারে।
বাজেট ঘাটতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা
আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এছাড়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা চলতি বছরের হালনাগাদ লক্ষ্যমাত্রা (৫.২৫%) এর চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকতে পারে।
টেলিভিশনে বাজেট ঘোষণা: নতুন বাস্তবতায় বাজেট উপস্থাপন
জাতীয় সংসদ না থাকায় এ বছর বাজেট উপস্থাপন হবে টেলিভিশনের পর্দায়, রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেই বাজেট ভাষণ দেবেন, যা সম্প্রচারিত হবে গণমাধ্যমে। এর আগে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম একইভাবে দুটি বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন।
সংকটের মধ্যেও স্থিতিশীলতা রক্ষা চেষ্টায় সরকার
এবারের বাজেট কমিয়ে আনার মূল কারণ রাজস্ব ঘাটতি, ঋণ পরিশোধের চাপ ও মূল্যস্ফীতির দাপট। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে প্রকৃত প্রয়োজনের জায়গাগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে একটি কার্যকর ও বাস্তববাদী বাজেট উপস্থাপন করা হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো খাতকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি এই বাজেট কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের দক্ষতা ও নীতি সিদ্ধান্তের ওপর।