অর্থনীতি

রাজস্ব বাড়াতে দুর্নীতি কর চালুর প্রস্তাব দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের 

দেশের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রস্তাব দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। শনিবার (৩১ মে) সকালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)-তে আয়োজিত একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ঋণ খেলাপি, কালো টাকার মালিক এবং অর্থ পাচারকারীদের কাছ থেকে জব্দকৃত অর্থ জাতীয় বাজেটে ‘দুর্নীতির কর’ নামে একটি নতুন খাতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।”

এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি একটি নৈতিক ও দায়বদ্ধ অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির ইঙ্গিত দেন, যা দেশের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

অবৈধ অর্থ বাজেট রাজস্বে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদকে আমরা জাতীয় রাজস্বে অর্থায়নের একটি উৎস হিসেবে নতুন একটা খাত সৃষ্টি করতে পারি—এটা আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা। এখনও পর্যন্ত এই ধরনের কার্যকর পদক্ষেপের কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”

তিনি আরও বলেন, “যেসব অর্থ জব্দ করা হয়েছে, তা বিক্রি করে সেই টাকা বাজেটের রাজস্বে নিয়ে আসা উচিত। শুধু আইনগত ব্যবস্থা নয়, বরং অর্থনৈতিক কাঠামোতে এটি অন্তর্ভুক্ত করাই সময়ের দাবি।”

এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন, দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা ও সংগঠিত একটি রাজস্ব কাঠামো তৈরি করা গেলে সেটি সরকারি রাজস্ব ঘাটতি কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

র কাঠামোতে সংস্কারের পরামর্শ

বর্তমানে দেশে কর আহরণের পরিমাণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম—এমনটি উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, “বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের হার এখনও সন্তোষজনক নয়। আমাদের উচিত হবে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের আওতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা।”

তিনি জানান, দেশের অনেক নাগরিক আয় করের আওতায় থাকলেও কর দেন না। অথচ পণ্য ও সেবার ওপর জারিকৃত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বা পরোক্ষ কর সব নাগরিকই দিচ্ছেন। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

করদাতাদের আস্থা অর্জনে স্বচ্ছতা জরুরি

সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে জনগণ কর দিতে উৎসাহিত হয় না—এমন বাস্তবতা তুলে ধরে ড. দেবপ্রিয় বলেন, “যখন জনগণ দেখে তাদের করের অর্থ অপচয় হচ্ছে বা অস্বচ্ছভাবে ব্যয় হচ্ছে, তখন কর প্রদান থেকে বিরত থাকে। তাই কর আদায়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”

তিনি মনে করেন, একটি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় করদাতাদের আস্থা ফিরে আসবে এবং তা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করবে।

বিদেশি ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের আহ্বান

দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ ঋণের চাপে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ব্যাহত হয়। তাই সরকারের উচিত হবে সুদস্বল্প বিদেশি ঋণের সুবিধা নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।”

এছাড়া সরকারের আর্থিক নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার লক্ষ্যে একটি কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

নৈতিক অর্থনীতি গঠনের ভাবনা

ড. দেবপ্রিয়ের প্রস্তাবে মূল যে ভাবনাটি উঠে আসে তা হলো—নৈতিক অর্থনীতি গঠন। যেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ একদিকে জব্দ হবে, অন্যদিকে তা দেশের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হবে। এর ফলে অপরাধীরা শাস্তি পাওয়ার পাশাপাশি সমাজের জন্য কিছু অবদান রাখতেও বাধ্য হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একদিকে যেমন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, তেমনি দেশের রাজস্ব খাতও হবে আরও সমৃদ্ধ।

তিনি বলেন, “এই অর্থ বাজেটের রাজস্বে অন্তর্ভুক্ত হলে সরকার নতুন উন্নয়ন খাতে ব্যয় বাড়াতে পারবে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।”

বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের এই প্রস্তাব নতুন হলেও তা বাস্তবায়নযোগ্য। তবে এর জন্য একটি শক্তিশালী আইনগত কাঠামো এবং জবাবদিহিমূলক রাজস্ব কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদ ড. ফারজানা আক্তার বলেন, “এমন একটি প্রস্তাব সময়োপযোগী। তবে দুর্নীতির অর্থ বাজেটের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজন সুশাসন, দক্ষ অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।”

অন্যদিকে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, “এ ধরনের একটি ব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে দুর্নীতির অর্থ কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে জব্দ করা হয়েছে, তা নিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন।”

উপসংহার

বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও নৈতিক কাঠামোর আওতায় আনতে হলে শুধুমাত্র কর বাড়ানো নয়, বরং করের উৎসের ধরন ও ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আনা জরুরি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের প্রস্তাব সেই পরিবর্তনের একটি নতুন দিক উন্মোচন করে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন যথাযথ বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button